বিশ্বদীপ কোনও ব্যতিক্রম ছিল না, সাগ্নিকও নয়।
বাবা যেমনটি চাইছিলেন তেমন খেলতে পারছিল না তরুণ টেবল টেনিস খেলোয়াড় বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য। রাগে অন্ধ হয়ে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ছেলেকে বেধড়ক মারেন বাবা দীপক ভট্টাচার্য। তার জেরেই প্রাণ হারায় ১৪ বছরের ছেলেটি।
আর মহেশতলার জগন্নাথপুরের ঘটনায় বাবা -মায়ের প্রত্যাশামতো পড়াশোনা করতে না পারার হতাশা ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সাগ্নিকের মনে। শনিবার রাতে ঘরের সিলিং থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। হাসপাতালে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘর থেকে একটি সুইসাইড নোটও মিলেছে। কিন্তু এলাকারবাসীদের অভিযোগ, পড়াশোনা নিয়ে সাগ্নিকের উপরে হামেশাই অত্যাচার করতেন বাবা অলোক রায়চৌধুরী। ওই রাতেও তার জেরেই মৃত্যু হয়েছে সাগ্নিকের। পরে বাড়ির লোকই দেহ সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পড়শিদের। শনিবারই সাগ্নিকের প্রি -টেস্টের রেজাল্ট বেরোয়। ৪টি বিষয়ে অকৃতকার্য হয় সে।
মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, অভিভাবকদের প্রত্যাশার চাপ কোথায় পৌঁছেছে, এমন ঘটনা তারই প্রমাণ। সাগ্নিকের মৃত্যুর কারণ যা -ই হোক, সে যে চূড়ান্ত মানসিক চাপে ছিল, তা নিয়ে সংশয় নেই। এ ভাবে মানসিক চাপে সন্তানকে জর্জরিত করার নজির এখন ঘরে -ঘরে। ‘যা চাই, আমার সন্তান তা দিতে পারছে না। আমার প্রত্যাশা ধাক্কা খাচ্ছে, আমি ঠকে যাচ্ছি’ এই বোধ থেকেই জন্মায় এক রকম মানসিক অসুস্থতা, যা এক জন বাবা কিংবা মা -কে সন্তানের প্রতিও নির্দয় করে তোলে। সাময়িক ভাবে সন্তানকে শত্রু মনে করে তাকে আক্রমণও করেন তাঁরা।
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের কথায়, “যে স্বাতন্ত্র্য আমি নিজে তৈরি করতে পারছি না, সন্তানের মাধ্যমে সেটা পাব এই চাহিদা মাঝে মাঝে উন্মত্ততার পর্যায়ে যায়। সন্তানের ক্ষমতা না বুঝেই নিজের চাহিদাগুলো অবিরাম চাপান অনেকে। তারই পরিণতি কখনও কখনও এমন ভয়াবহ হয়ে ওঠে।”
একই মত মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের। তাঁর বক্তব্য, “এমন আগেও ঘটত। এখন সেগুলি সামনে আসছে। বাবা -মায়ের ব্যক্তিগত হতাশা, অসাফল্য প্রকাশ পাচ্ছে সন্তানের উপরে প্রত্যাশায়।” একে বাবা -মায়ের মানসিক অসুস্থতা বলে মনে করছেন তিনি। তাঁর কথায়, “এই বাবা -মায়েরা হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে চাপে থাকেন, নেশা করেন, অসাফল্য তাঁদের নিত্য সঙ্গী। এর থেকেই এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, যা প্রকাশ পায় সন্তানের উপরে।”
মনোবিদ মোহিত রণদীপ বলেন, “নিজের প্রত্যাশার ভারে সন্তানকে নুইয়ে ফেলার ঘটনা তথাকথিত শিক্ষিত, প্রগতিশীল পরিবারেই হয়তো বেশি। অনেকেই মারছেন না, কিন্তু মানসিক নির্যাতন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। আমাদের কাছে বয়ঃসন্ধির সন্তানদের নিয়ে আসা সংখ্যাগরিষ্ঠেরই অভিযোগ, সন্তানের রেজাল্ট চাহিদা মতো হচ্ছে না। তাই কখনও বুঝে, কখনও না -বুঝে সন্তানের উপরে চাপ তৈরি করছেন।”
মনোবিদেরা বলছেন, এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং উল্টো ফল হচ্ছে। নীলাঞ্জনাদেবীর কথায়, “সকলে অত্যাচারের জেরে মারা যায় না। মনটা মরে যায়। ব্যক্তিত্বের কাঠামোটাই টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। তার পরে সফল হওয়া সম্ভব?” জয়রঞ্জনবাবু বলেন, “ভয় দেখিয়ে কি মোটিভেশন তৈরি হয়? সন্তানকে বুঝিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এটা অভিভাবকেরা না বুঝলে আরও ভয়ঙ্কর দিন আসছে।” আর মোহিতবাবুর কথায়, “ক্রমাগত সন্তানকে বলা হচ্ছে ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না’। অন্যের সঙ্গে তুলনায় তার আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকছে। সে আরও পিছিয়ে পড়ছে। তৈরি হচ্ছে হতাশা, অবসাদ। যার জেরে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে।”
|