অনুমোদনের ‘স্বচ্ছতা’য় সংশয়
এমসিআই পরিদর্শক দলে শুধু ডাক্তারেরা কেন, প্রশ্ন
কিছু দিন আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন সংস্থার খোদ শীর্ষ কর্তা।
এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র সেই প্রেসিডেন্ট কেতন দেশাই ধরা পড়ার পরে কাউন্সিলের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। এ বার হলদিয়ার সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদনকে ঘিরে দানা বাঁধা বিতর্ক একই প্রশ্নকে ফের সামনে এনে দিল।
কাউন্সিলের স্বচ্ছতা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের অভিযোগ: শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়, একই পেশায় ‘সদ্ভাব’ রক্ষার খাতিরেই বহু ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর অভাব ‘দেখেও দেখেন না’ কাউন্সিল-সদস্যেরা। যে কারণে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ বিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও দিব্যি ছাড়পত্র আদায় করে নেয়।
আর এই সমস্যার সমাধানেই কাউন্সিলে অন্য পেশার মানুষদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সরব হয়েছেন তাঁরা।
বস্তুত এমসিআই বোর্ড অফ গভর্নর্সের ছ’জন সদস্য সকলেই চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত। কাউন্সিলের অন্য ২২ জন পদাধিকারীর মধ্যেও আইনজীবী ও প্রশাসনিক কর্মী ছাড়া সকলেই চিকিৎসক। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে পরিদর্শনে যান যাঁরা, তাঁরাও চিকিৎসক। ‘ভাই-বেরাদরি’ বজায় রাখতেই তাঁরা বহু ক্ষেত্রে চোখ বুজে থাকছেন বলে অভিযোগ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সক্রিয় নানা সংগঠন কাউন্সিলে অ-চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্তির জন্য ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দ্বারস্থ হয়েছে। মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের মতামতও চাওয়া হয়েছে।
এমসিআইয়ের কী বক্তব্য?
কাউন্সিলের সচিব সঙ্গীতা শর্মা অবশ্য পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, “দেশে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক কম থাকায় মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। সেই কারণেই বহু ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেওয়ার সময়ে প্রথম বছরে বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়। অন্য কোনও কারণ নেই। কাউন্সিলে অন্য পেশার লোকজন এলে তাঁদেরও দেশের চাহিদার কথা মাথায় রাখতে হবে।”
তা হলে কি অ-চিকিৎসক সদস্য নেওয়ার প্রস্তাবে তাঁরা আমলই দিচ্ছেন না?
সঙ্গীতাদেবী জানাচ্ছেন, “পরিস্থিতির সঙ্গে তাল রেখে শিগগিরই কাউন্সিলে কিছু রদবদল হচ্ছে। এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।” এমসিআইয়ের আইনজীবী অমিত কুমারেরও একই বক্তব্য। কিন্তু কাউন্সিলের বাইরে চিকিৎসাক্ষেত্রে জড়িত বিভিন্ন মহল বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছেন?
স্ত্রী অনুরাধা সাহার মৃত্যুর পরে রোগীর অধিকার নিয়ে লাগাতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন যে প্রবাসী চিকিৎসক, সেই কুণাল সাহা মনে করেন, এমসিআইয়ে অ-চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্ব থাকা একান্ত জরুরি। তাঁর কথায়, “শুধু যে রাজ্য কাউন্সিলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিষ্পত্তির সময়ে অ-চিকিৎসকদের উপস্থিতি দরকার, তা-ই নয়। আমাদের দাবি, মেডিক্যাল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ক্ষেত্রেও অ-চিকিৎসকদের আনা হোক। যন্ত্রের খুঁটিনাটি তাঁরা না-ও বুঝতে পারেন। তবে কোন বিভাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক রয়েছেন, পড়ুয়াদের ল্যাবরেটরি বা হস্টেল ঠিকঠাক রয়েছে কি না, সেগুলো তো তাঁরা বিচার করতেই পারবেন!” চিকিৎসক সংগঠন ‘হেল্থ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রাক্তন সভাপতি সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “ডাক্তারেরা এমসিআইয়ে থেকেই বা কী করছেন? বোঝাই যাচ্ছে, অধিকাংশ অনুমোদনের সময়ে চোখ-কান বুজে থাকা হয়। এমসিআইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতার ভিতটাই তো এখন টলোমলো! যাঁরা চিকিৎসক নন, তাঁদের কমিটিতে আনলে ভাল বই খারাপ হবে না।”
কুনালবাবু-সঞ্জীববাবুর পাশাপাশি এ রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারাও মনে করছেন, এমসিআইয়ের গঠনতন্ত্র নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তার সময় এসেছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, কাউন্সিলের স্বচ্ছতা বৃদ্ধির স্বার্থেই কাঠামোটাকে ঢেলে সাজা প্রয়োজন।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক আমলা বলেন, “দেশের মেডিক্যাল-শিক্ষার রূপরেখা নির্ণয়ের ভার যাদের হাতে, মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদনে শেষ কথা যারা, তাদের নিরপেক্ষতা বজায় থাকাটা খুব জরুরি। কাউন্সিল তো প্রেসক্রিপশন লিখছে না! সুতরাং ডাক্তার হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা না-থাকাই ভাল। যে কোনও ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কাউন্সিলের দায়িত্বে এলে সাধারণ মানুষের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।”
যদিও এর উল্টো মতও রয়েছে। কী রকম?
যেমন প্রবীণ সরকারি চিকিৎসক, তথা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের যুক্তি, কোনও প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল-শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে কি না, অ-চিকিৎসকদের পক্ষে তা যাচাই করা অসম্ভব। “কোনও বিষয়ে এমডি কোর্স চালু করতে হলে কী কী পরিকাঠামো থাকা উচিত, সেটা বুঝবেন শিক্ষক-চিকিৎসকেরা। যাঁরা চিকিৎসক নন, তাঁরা কী করে বুঝবেন?” প্রশ্ন তুলছেন সুবীরবাবু। তাঁর আরও সংশয়, “দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব ঠেকাতে অ-চিকিৎসকদের এমসিআইয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়াবেন না, সেই গ্যারান্টি কে দেবে?”
কাউন্সিলে অ-চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে যাঁরা সওয়াল করছেন, তাঁরা অবশ্য এই সব যুক্তি-প্রশ্ন-সংশয়ে বিশেষ সারবত্তা আছে বলে মানেন না। কারণ, এমসিআইয়ে চিকিৎসক এবং অ-চিকিৎসকের সমান-সমান অংশগ্রহণ তাঁরা চাইছেন না। বরং ওঁরা চাইছেন, কাউন্সিলের পরিদর্শকদলে সমাজের অন্যান্য মহলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকুক।
আর স্বাস্থ্যের সঙ্গে যে হেতু সরাসরি মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত, তাই অন্য ক্ষেত্রের প্রতিনিধিরা নিজেদের স্বার্থেই দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দেবেন বলে এই মহলের আশা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.