সরকার কী চায়, তা সরাসরি লিখিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই জানাতে বলল মাওবাদীরা। তারা আরও বলেছে, সরকারের ‘লিখিত মতামত’ পেলে তবেই তারা তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত
জানাতে পারে।
মাওবাদীরা ওই বক্তব্য পেশ করেছে একটি খোলা চিঠিতে। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে সরকার-মাওবাদী আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীদের। শনিবার সুজাত ভদ্র-সহ মধ্যস্থতাকারী কমিটির সদস্যদের কাছে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে (চিঠিটির তারিখ ২৬ অক্টোবর। কালীপুজোর দিন) মাওবাদী নেতা আকাশ বলেছেন, ‘সরকার কিংবা মুখ্যমন্ত্রী যা বলতে চান, লিখিত ভাবে আমাদের বলবেন। আমরাও আমাদের মতামত লিখিত ভাবে জানাব। এটার মধ্যে দিয়েই আলোচনার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা থাকতে পারে বলে আমরা মনে করি।’
সুজাতবাবুকে লেখা চিঠিতে সরাসরিই মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকার ‘সমালোচনা’ করে বলা হয়েছে, ‘জঙ্গলমহলের পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে, তা দেখে আপনাদের কী মনে হচ্ছে?... শান্তি আলোচনার নামে আক্রমণের সমস্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে মমতা সরকার। এ বিষয়ে আপনারা চুপ করে থাকছেন। কিছু বলছেন না’।
মধ্যস্থতাকারীদের যে রাজ্য সরকার নিয়োগ করেছিল, তা জানিয়ে আকাশের নামে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা এক মাসের যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করেছিলাম। এই ঘোষণাপত্রে আপনারাও স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু তার পরেও ১৫ অক্টোবরের সভায় মমতা যে ভাষায় প্রত্যুত্তর দিলেন, তার পরে তিনি শান্তি আলোচনায় আদৌ আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে না।’ উল্লেখ্য, মাওবাদীদের দেওয়া ওই বিবৃতিতে সুজাতবাবুর স্বাক্ষর থাকা নিয়ে প্রশাসনের একাংশ ‘অখুশি’ ছিল। মহাকরণের বক্তব্য ছিল, যে বিবৃতিতে মাওবাদীরা সরকারের উপর ‘শর্ত’ চাপাচ্ছে, সেখানে কী করে এক মধ্যস্থতাকারী সই করেন? সে ক্ষেত্রে তো তাঁর ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়!
এ দিনের চিঠিতে মাওবাদীরা কী চায়, তা লিখিত ভাবে তাদের জানানোর পাশাপাশিই সরকার কী চায়, তা-ও স্পষ্ট করে জানানোর দাবি তোলা হয়েছে। মাওবাদী নেতা আকাশের নামে লেখা চিঠিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও ভাবেই অস্ত্র সমর্পণ আলোচনার বিষয় (এজেন্ডা) হবে না।
এত দিন শান্তি-প্রক্রিয়ার জন্য মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন মধ্যস্থতাকারীরা। কিন্তু তারা যে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকায় ‘সন্তুষ্ট’ নয়, চার পাতার খোলা চিঠির মাধ্যমে মাওবাদীরা তা স্পষ্ট করে দিল। বরং তারা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকেই লিখিত মতামত চেয়েছে। আকাশের অভিযোগ, রাজ্য সরকার শান্তির পরিবেশ ‘ভঙ্গ’ করছে। প্রতিদিনই যৌথ বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে।
আকাশের চিঠি পাওয়ার পরে সুজাতবাবু, ছোটন দাস-সহ ৬ সদস্যের মধ্যস্থতাকারী দলের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। সুজাতবাবু পরে জানান, তিনি এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলছেন না। কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে যা বলার বলবেন। একই কথা ছোটনবাবুরও। আকাশের খোলা চিঠির পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে শান্তি-প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীদের কি আর আদৌ কোনও ভূমিকা থাকছে? প্রসঙ্গত, মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রী নিজেও যথেষ্ট ‘সন্তুষ্ট’ নন। সম্প্রতি মহাকরণে সুজাতবাবুদের সঙ্গে বৈঠকে তা স্পষ্টওকরে দিয়েছিলেন মমতা।
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, যে দুই পক্ষের মধ্যে সুজাতবাবুরা ‘মধ্যস্থতা’ করছিলেন, সেই দু’পক্ষই তাঁদের ভূমিকায় ‘অসন্তুষ্ট’।
শান্তি ও উন্নয়নের প্রশ্নে সরকার ঠিক কী চাইছে, তা যেমন ওই চিঠিতে লিখিত ভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে, তেমনই সুজাতবাবুদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘এখনও পর্যন্ত শান্তি-প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে আপনাদের সাথে দু’বার বসা হল। যে সব বিষয় নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা হল, সরকারের পক্ষ থেকে তার কোনও একটাও কার্যকর হয়নি। সরকার কোনও বক্তব্যই গ্রহণ করেনি বলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। আমরা আমাদের বক্তব্য লিখিত ভাবে পাঠালাম। রাজ্য সরকারকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।’
খোলা চিঠিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে আকাশের তরফে ১৩ দফা দাবিও পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘মমতাকে হুমকি কিংবা অনাগরিক আচরণ বন্ধ করতে হবে। কোনও দলকে জঙ্গল মাফিয়া বা সুপারি কিলার বলে ছাপ্পা মেরে আক্রমণ করা একটা ফ্যাসিবাদী আচরণ’। সম্প্রতি ঝাড়গ্রামের সভায় মমতা মাওবাদীদের ‘সুপারি কিলার’ বলে সম্বোধন করেন।
মাওবাদীদের বক্তব্য নিয়ে মধ্যস্থতাকারীরা গত ১৮ অক্টোবর মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ‘কিন্তু নিজের কথা বলা ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী অন্য কিছু শোনার জায়গায় নেই’ তা জানিয়ে মাওবাদীদের অভিযোগ, ‘এ ভাবে শান্তি-প্রক্রিয়া চলে না। কিছু নাটুকে কথাবার্তা এবং অলিখিত কিছু কথাবার্তার উপর ভিত্তি করে এগোনোর অর্থ হচ্ছে, অনর্থক সময় নষ্ট করা’। মাওবাদীদের আরও প্রশ্ন, ‘দু’পক্ষ তাদের কথা রাখছে কিনা, তা ‘মনিটরিং’ করার লোক কারা?’ সাধারণত এ সব ব্যাপারে ‘মনিটরিং’-এর দায়িত্বও মধ্যস্থতাকারীদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে তা রক্ষিত হচ্ছে না, মাওবাদীদের চিঠিতে তা স্পষ্ট।
তারা মধ্যস্থতাকারীদের ‘মান্যতা’ দিলেও মধ্যস্থতাকারীরা কেন সরকারকে কিছু বলছেন না, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে আকাশের চিঠিতে। তাদের অভিযোগ, যৌথ বাহিনী, তৃণমূলের নেতৃত্বে মোটর সাইকেল বাহিনী প্রতিদিন গ্রাম তছনছ করছে। মাওবাদীদের দাবি, সব রকম সভার অনুমতি দিতে হবে এবং কোনও ভাবেই যৌথ বাহিনী কোনও সভায় বাধা দিতে দিতে পারবে না। সম্প্রতি আদিবাসী মহিলাদের একটি সভার অনুমতি দেয়নি যৌথ বাহিনী।
১৩ দফা দাবির মধ্যে তৃণমূলের কার্যকলাপ বন্ধ করারও দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভৈরব-বাহিনী ও প্রতিরোধ কমিটির সভায় কোনও তৃণমূলের নেতা অংশ নিতে পারবেন না। রাজ্যব্যাপী সর্বত্র তৃণমূল গুণ্ডাগিরি, খুন, সন্ত্রাস, রক্তপাত চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে তা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। সম্প্রতি তৃণমূলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী মাওবাদীদের ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে জঙ্গলমহলে সভা করেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ও সভা করেছেন। ওই দুই নেতাকেই চিঠিতে কটূক্তি করা হয়েছে। তাঁদের সভা করা যে মাওবাদীদের ‘না-পসন্দ’, চিঠি থেকে তা স্পষ্ট।
মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরে আসতে পারে বলে সাধারণ মানুষের একাংশ মনে করছেন। অনন্তকাল অপেক্ষা করতে রাজি না-থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতাও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু সেই আলোচনা যে কোনও ভাবে ‘কার্যকর’ হচ্ছে না, তা জানিয়ে আকাশের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জনগণের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে অকারণ মোহ সৃষ্টি করা ঠিক নয়’। মাওবাদীদের অভিযোগ, সিপিএমের ‘হার্মাদ-বাহিনী’ স্কুল দখল করে পড়ুয়াদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিত। এখন তৃণমূলের ‘ভৈরব-বাহিনী’ রাস্তার উপর পাঁচিল তুলে দিয়ে ১০-১৫টি গ্রামের পড়ুয়াদের স্কুলে ঢোকা বন্ধ করেছে। |