|
|
|
|
আগামী এক মাসে শিল্প নিয়েই ‘নাড়াচাড়া’, ঘোষণা করলেন এক গুচ্ছ প্রকল্প |
শিল্পমহলের আস্থা পেতে ময়দানে এ বার মমতাই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ক্ষমতায় আসার পর গত পাঁচ মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেকটা সময়ই গিয়েছে সিঙ্গুর, জঙ্গলমহল ও দার্জিলিং নিয়ে। শিল্পায়ন নিয়ে তিনি কোন পথে হাঁটেন, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের আগ্রহ থাকলেও এত দিন সরাসরি সক্রিয় হননি মমতা। কিন্তু শনিবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, আগামী এক মাস তিনি শুধু শিল্প নিয়েই ‘নাড়াচাড়া’ করবেন। লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গে ‘শিল্প বিপ্লব’ আনা। বস্তুত শিল্পায়ন নিয়ে সক্রিয় হয়ে এ দিনই কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মাকে ফোন করে রাজ্যে দু’টি বস্ত্র শিল্পতালুক তৈরির দাবি জানিয়েছেন মমতা। সিঙ্গুরে রেলের কারখানা করার ব্যাপারে কথা বলেছেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে।
শনিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী এক মাস বাংলায় শিল্পায়নের প্রক্রিয়া ‘ছুটতে ছুটতে দৌড়বে’। আটকে থাকা শিল্প বিনিয়োগের সমস্ত প্রস্তাব ছ’মাসের মধ্যে মঞ্জুর করে দেওয়া হবে। দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা বাংলার ছেলেমেয়েদের সামনে অনেক চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। এটাই রাজ্যবাসীকে তাঁর ‘দীপাবলির উপহার’।
গত পাঁচ মাসে দু’বার শিল্পপতিদের মুখোমুখি হয়েছেন মমতা। প্রথম বার ক্ষমতায় আসার ঠিক পরেই আলিপুরে। দ্বিতীয় বার, চলতি মাসে বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষে বালিগঞ্জে। রাজ্যের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে শিল্পপতিদের মধ্যে কোথাও যে একটা আস্থার অভাব রয়েছে, সেটা বালিগঞ্জেই টের পেয়েছিলেন মমতা। শিল্পের জন্য জমি পাওয়া নিয়ে সংশয়ের পাশাপাশি শিল্পপতিদের মধ্যে এই ধারণাও তৈরি হচ্ছিল যে, স্বাস্থ্য বা শিক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যতটা সক্রিয়, শিল্প নিয়ে ততটা নন। শিল্প দফতরের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দফতরের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার অসুবিধা নিয়ে অসন্তোষও বিভিন্ন মহলে ব্যক্ত করছিলেন তাঁরা। |
|
তৃপ্তি। হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের ইঞ্জিনিয়ারদের
সঙ্গে বৈঠকের ফাঁকে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি : বিশ্বনাথ বণিক |
শিল্পমহলের আস্থা পেতে প্রাথমিক ভাবে কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা। তাঁর নির্দেশেই রাজ্যে শিল্প স্থাপনের জন্য ৯৩ পাতার জটিল আবেদনপত্রের পরিবর্তে সাত পাতার সহজ আবেদনপত্র চালু হয়েছে। শিল্পোন্নত জেলাগুলিতে শিল্পস্থাপনে চালু হয়েছে ‘এক-জানলা’ ব্যবস্থা। শিল্পপতিদের কাছ থেকে কেউ তোলা চাইলে বা জুলুম করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এতেও যে শিল্পমহল খুব বেশি আশ্বস্ত হয়নি, সেই বার্তা পৌঁছচ্ছিল মমতার কাছে। তাই তাদের আস্থা অর্জনে শনিবার শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার রাশ সরাসরি নিজের হাতে নেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন তিনি।
কালীপুজো ও ভাইফোঁটা উপলক্ষে তিন দিন ‘ছুটি’ নেওয়ার পর শনিবার মহাকরণে এসেই শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত ও মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। আড়াই ঘণ্টা বৈঠকের ফাঁকে টেলিফোনে কথা বলেন আনন্দ শর্মা ও রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে। তার পর
সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন শিল্পায়ন নিয়ে তাঁর সরকারের দিশা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সিঙ্গুর মামলায় রাজ্য সরকার জিতেছে। (ঘটনাচক্রে এ দিনই কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নোটিশ দিয়েছে টাটা মোটরস) এখন অনিচ্ছুক কৃষকদের ৪০০ একর বাদ দিয়ে বাকি ৬০০ একর জমিতে মেট্রো রেলের কোচ কারখানা করা যায় কি না, তিনি তা রেলমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন। রেলমন্ত্রী এ দিন তাঁকে জানিয়েছেন, রেল সিঙ্গুরের ওই জমিতে মেট্রো রেলের কোচ কারখানা করতে চায়। সেল ইতিমধ্যেই সিঙ্গুরে ওই কারখানা করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহের কথা রাজ্য সরকারকে জানিয়েছে। রেল ও সেল মিলে যদি ওই কারখানা করে, তা হলে তিনি খুশি হবেন।
নয়াচরের প্রকল্প মঞ্জুর করে দেওয়ার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, শিগগির সেখানেও কাজ শুরু হবে। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পরে জানান, নয়াচর প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কাল, সোমবার নতুন করে সমঝোতা হবে। তাতে নতুন কিছু জিনিস ঢুকবে। কিছু জিনিস বাদ যাবে। আগের পিসিপিআইআর (পেট্রোলিয়াম, কেমিক্যালস অ্যান্ড পেট্রোকেমিক্যালস ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন) নামটি থাকবে না। সেখানে হবে ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প,বদ্যুৎ প্রকল্প এবং শিল্প পার্ক। উপকূলবর্তী এলাকার বিধিনিষেধ মাথায় রেখেই ওই প্রকল্প গড়ে তোলা হবে।
শিল্পের জন্য জমি নিয়ে শিল্পপতিদের সংশয় দূর করতে এ দিন তাঁদের উদ্দেশে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, রাজ্যে অনেক বন্ধ ও রুগ্ণ শিল্পসংস্থার কাছে সিলিং-বহির্ভূত জমি রয়েছে। জমি আইনে ২৪ একরের বেশি জমি না-রাখতে পারার যে বিধান রয়েছে, তার তোয়াক্কা না-করে পূর্বতন সরকার ওই সব জমি রাখতে দিয়েছিল। এর মধ্যে সাত-আটটি সংস্থা জানিয়েছে, তারা সিলিং-বহির্ভূত জমিতে শিল্প করতে চায়। রাজ্য মন্ত্রিসভা প্রতিটি প্রস্তাব আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করবে। সিলিং বহির্ভূত জমিতে কোনও সংস্থা সত্যি সত্যিই শিল্প করলে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। শিল্পমন্ত্রী জানান, জিন্দলদের শালবনি প্রকল্পের জমি নিয়ে অনুরূপ জটের বিষয়টি আগামী মঙ্গলবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করা হবে। |
সহাস্যে...
|
সাংবাদিক বৈঠকের ঠিক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সঙ্গে রয়েছেন অন্য মন্ত্রীরাও। শনিবার মহাকরণে। —নিজস্ব চিত্র |
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আসানসোলে ‘এইচপিএল’ ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গ্যাস-ভিত্তিক শিল্প গড়বে। তার পাশাপাশি মাটির নীচ দিয়ে আসা গ্যাস কলকাতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে সস্তার রান্নার গ্যাস। ‘গেল’, ‘এইচপিএল’ ও গ্রেটার
ক্যালকাটা গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশনের সহযোগিতায় ওই প্রকল্প চালু হয়ে গেলে তা কলকাতাকে লন্ডন বানানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী যে ঘোষণা করেছেন, সেই লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ হবে বলে কথাচ্ছলে জানান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। কারণ, লন্ডনে সর্বত্র গ্যাস সরবরাহ করা হয় পাইপলাইন দিয়েই।
এ রাজ্যে মোটরবাইক শিল্পে এ বার সরাসরি বিনিয়োগ করবে টিভিএস। বামফ্রন্ট আমলে উলুবেড়িয়ায় ‘অর্জুন’ মোটরবাইক তৈরির প্রকল্প নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের সেই ‘মহাভারত’ কারখানায় এত দিন চুক্তির ভিত্তিতে মোটরবাইক তৈরি করত টিভিএস। এ বার থেকে যৌথ উদ্যোগে তা করতে দু’পক্ষের চুক্তি হয়েছে।
খড়্গপুরে কারখানা গড়বে ট্র্যাক্টরস ইন্ডিয়া। হলদিয়ার লাগোয়া জেলিংহামে রেল, সেল, বার্ন স্টান্ডার্ড ও রাজ্য সরকার মিলে তৈরি করবে শিল্প পার্ক। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের পাশাপাশি রাজ্যে গড়ে তোলা হবে সেন্টার ফর এক্সসেলেন্স। যাতে এখন রাজ্যের যে-সব ছলেমেয়ে বাইরে রয়েছেন, তাঁরা নিজের রাজ্যে ফিরে কিছু করতে পারেন।
আগামী ৪ নভেম্বর হাওড়ার দাশনগরে এনটিসি-র একটি স্পিনিং মিলের পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন আনন্দ শর্মা। সেখানে কেন্দ্র ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। আনন্দ শর্মার সঙ্গে ওই দিন কেন্দ্রের একটি প্রতিনিধি দল আসবে। রাজ্যের শিল্প মহল ও সরকারের সঙ্গে তাদের সবিস্তার আলোচনা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এ রাজ্যে দু’টি বস্ত্র শিল্পতালুক তৈরির জন্য এ দিন তিনি টেলিফোনে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন। আনন্দ শর্মা একটি করতে রাজি বলে জানান। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি দু’টি তালুকই চেয়েছেন। কারণ, তাঁত, সুতি, রেশম এবং পাটজাত দ্রব্যের শিল্পে এ রাজ্যের মানুষের দক্ষতা থাকলেও সেগুলি এখন ধুঁকছে। রাজ্য সরকার ওই সব শিল্পের পুনরুজ্জীবন চায়।
চটের বস্তার ১০০ শতাংশ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি রাজ্যের পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী সপ্তাহের মধ্যে পাটচাষিদের জন্য বাড়তি সহায়ক মূল্যের ব্যাপারটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।
দেশের শিল্প মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরতে দিল্লির বাণিজ্য মেলার উপরে গুরুত্ব দিচ্ছে রাজ্য সরকার। প্রগতি ময়দানের এই মেলায় সহযোগী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও এ জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে কসুর করেনি রাজ্য। ২৮ নভেম্বর মেলায় পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালিত হবে। মমতার সে দিন মেলায় উপস্থিত থাকার কথা। ওই দিন দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএএস অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি রাজ্যে শিল্পস্থাপনের জন্য তাঁদের সক্রিয় হতে অনুরোধ জানাবেন বলেও মহাকরণ সূত্রে খবর।
|
এক নজরে |
•
সিঙ্গুরের ৬০০ একর জমিতে মেট্রো
রেলের কোচ তৈরির কারখানা।
•
শিলিগুড়ি, কাঁচরাপাড়া, ডানকুনি, বজবজ ও কুলটিতে রেলের কারখানা।
•
শিল্প স্থাপনে প্রকৃত আগ্রহীদের ক্ষেত্রে
জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল।
• নদিয়া, মুর্শিদাবাদ অথবা বর্ধমানে
দ্বিতীয় একটি বস্ত্র শিল্পগুচ্ছ।
•
আসানসোলে ১০০০ কোটি টাকায় এইচপিএল-এর গ্যাস-ভিত্তিক শিল্প।|
•
বৃহত্তর কলকাতায় পাইপ লাইনের
সাহায্যে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প। |
|
•
জেলায় জেলায় ১৭টি শিল্প-তালুক।
• হলদিয়ায় ওয়াগন শিল্প।
•
জেলিংহামে শিল্প পার্ক।
•
দাশনগরে স্পিনিং মিল।
•
ধনেখালিতে বস্ত্র শিল্পগুচ্ছ।
•
পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন।
•
খড়্গপুরে ট্রাক্টরস ইন্ডিয়ার কারখানা।
•
নয়াচরে ইকো-ট্যুরিজম,
বিদ্যুৎ প্রকল্প ও শিল্প পার্ক।
•
উলুবেড়িয়ায় টিভিএস-এর বাইক কারখানা।
•
বিভিন্ন ইস্পাত প্রকল্পে সেল-এর
২০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ।
|
|
|
|
|
|
|