যে বাড়ি উকিল-মক্কেলে গমগম করার কথা, সেখানে গোখরোর হিস হিস, শেয়ালের সংসার। তালাবন্ধ এজলাসের জানালাও খোলা। ওটা এখন ভামেদের জাতীয় সড়ক। জলপাইগুড়ির প্রস্তাবিত সার্কিট বেঞ্চ রীতিমতো শ্বাপদসঙ্কুল। বন্দুক ছাড়া নিরাপত্তাকর্মীরা ভিতরে ঢোকেন না।
সার্কিট বেঞ্চ কবে উদ্বোধন হতে পারে তা নিয়ে নানা মহলে বছরভর জল্পনা চলে। এখনও চলছে। হঠাৎই সবার অজান্তে সার্কিট বেঞ্চের অস্থায়ী ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যত বন্ধ। ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেসরকারি সংস্থার কয়েক জন কর্মী দায়িত্বে ছিলেন। সামনের সাজানো বাগানের পরিচর্যার জন্য ছিলেন এক জন মালিও। মাস পাঁচেক হল তাঁরা কেউ কাজে আসেন না। তাই প্রায় হানাবাড়ির চেহারা নিয়েছে অস্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ ভবন।
ভবনের সামনের বাগান শুকিয়ে গিয়ে জংলি গাছের জঙ্গল তৈরি হয়েছে। ভবনের পিছনের অংশের অবস্থাও তথৈবচ। ভবনের ডান দিকের জঙ্গল এতটাই ঘন এবং বড় যে, সেদিকে পা ফেলাই মুশকিল। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মীরা সাপের উপদ্রবে নাজেহাল। ভবনের মেঝেতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। |
জলপাইগুড়ির প্রস্তাবিত সার্কিট বেঞ্চ ভবন। সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
দিনের বেলাতেও বিষধর সাপেদের দেখা যায় বলে নিরাপত্তা কর্মীরা জানিয়েছেন। জানালার সব কাচ ভাঙা। উন্মুক্ত জানালা দিয়ে ভাম ঢুকে এজলাসে বাসা বানিয়েছে। ভবনের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশকর্মী বললেন, “সন্ধের পরে গোটা বাড়ি জুড়ে ভামের দল দাপিয়ে বেড়ায়। এজলাসের ভিতর থেকে ভেসে আসে বিকট শব্দ। সর্বত্র বিষধর সাপ ঘুরে বেড়ায়। আমরা যে কী করে রয়েছি তা কল্পনাই করা যায় না।”
জলপাইগুড়ির জেলা পরিষদের অস্থায়ী ডাকবাংলোয় বানানো হয়েছে সার্কিট বেঞ্চের অস্থায়ী ভবন। চারটে বাতানুকূল এজলাস। বিচারপতিদের বসার ঘর, বার লাইব্রেরি, আইনজীবীদের বসার ঘর, সবই এই ভবনে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রতিনিধিদল দফায় দফায় ভবন পরিদর্শন করে পরিকাঠামো নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে গিয়েছেন। শেষ পরিদর্শন হয়েছে ২০১০ সালের ২৪ জুলাই। তার পর থেকে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে ভবনটি। কবে সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন হবে, তা কেউ জানে না। কোনও ধারণাও নেই।
সার্কিট বেঞ্চের ভবনের দু’নম্বর গেট দিয়ে বিচারপতি এবং ভিভিআইপিদের গাড়ি ঢুকবে। তার দু’দিকে সার্কিট বেঞ্চ লেখা কাচের হোর্ডিং কবেই ভেঙে চুরমার। বাড়ির সামনে থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভবনের ঘরগুলি তালা বন্ধ থাকলেও প্রতিটি জানালা খোলা। পাখির বাসা থেকে শুরু করে তিন চার হাত লম্বা মাকড়সার জাল তৈরি হয়েছে দেওয়ালে। মঙ্গলবার দুপুরে ভবনের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই দৌড়ে এসে বাধা দিলেন এক পুলিশকর্মী। তিনি বললেন, “খবরদার যাবেন না। কত রকমের বিষধর সাপ ভিতরে রয়েছে জানি না। সাপের সামনে না পড়লেও শেয়াল বা ভাম এসে আঁচড়ে দিতে পারে। বন্দুক ছাড়া আমরাও ভেতরে ঢুকি না।”
সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধন নিয়ে বছরের পর বছর ধরে টালবাহানা চলতে থাকাতেই অস্থায়ী ভবনের এই দশা বলে অভিযোগ জলপাইগুড়ির আইনজীবী মহলের। মাঝেমধ্যে সরকারি কর্তাদের পরিদর্শনের সময়ে রঙ করা হত। এখন পরিদর্শনও বন্ধ। তবে ভবনের বর্তমানে যে দশা হয়েছে তার হাল ফেরাতে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে এবং মাসখানেকের আগে তা সম্ভব নয় বলে জেলা প্রশাসনের বাস্তুকারেরা মনে করেন। জলপাইগুড়ির আইনজীবী তথা বার কাউন্সিল সদস্য গৌতম দাস বলেন, “কোনও মহল থেকেই সার্কিট বেঞ্চ উদ্বোধনের কোনও বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে জলপাইগুড়িবাসীর সামনে ফের দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়া ছাড়া বিকল্প পথ নেই।” |