|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
শেষের কবিতা |
|
অমিত-লাবণ্য নয়, রবীন্দ্রনাথের অন্তিম কবিতাগুচ্ছ।
‘শেষ লেখা’। প্রীতীশ নন্দীর অনুবাদ।
পরেশ মাইতির ছবি।
অন্য আঙ্গিকে রবীন্দ্র-স্মরণ। সিমা গ্যালারিতে।
শোভন তরফদার |
|
|
কারও কি টুনুর কথা মনে পড়ে? সেই যে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির মুখ্য চরিত্র সিদ্ধার্থের আগুনখোর নকশাল ভাই, বেঁচে থাকলে এই জি.ওয়ানের যুগে যার বয়েস হত ষাটের এ দিক ও দিক, সেই টুনু!
ধরা যাক, সেই টুনুরই বয়সী কেউ, যারা সত্তর দশকের গোড়ায় খুব কাছ থেকে দেখল মৃত্যু, দেখতে দেখতে মৃত্যুর সঙ্গেই বিচিত্র একটা টানে জড়িয়ে গেল, আর সেই গনগনে সময়ের আঁচ ঈষৎ নিভে এলে, মাত্র একুশ বছর বয়সে অনুবাদ করল এমন একটি বই, যার প্রতিটি কবিতায় আছে জীবন আর মৃত্যুর আলোছায়া?
নাকি, ‘মৃত্যুর নিপুণ শিল্প’?
প্রীতীশ নন্দী বললেন, ‘আমরা মৃত্যুকে ভালবাসতাম। আমি একা নই, আমাদের প্রজন্মের আরও অনেকেই। দিনবদলের স্বপ্ন বুকে নিয়ে কলেজে আমাদেরই ব্যাচ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল একঝাঁক উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে, ফলে মৃত্যু নিয়ে আমাদের একটা ঘোর ছিলই। সেই ঘোর থেকেই রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ লেখা’র ওই অনুবাদ।’
উনিশশো বাহাত্তর নাগাদ অনুবাদের পালা শুরু, বই বেরোল পরের বছর, মাত্র একশো কপি।
প্রীতীশ জানাচ্ছেন, কেন মাত্র একশো! ‘আসলে তখন তো কপিরাইটের ব্যাপারটা ছিল, সে জন্যেই বেশি ছাপিনি, ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত যদি মামলা করেও বিশ্বভারতী, মাত্র একশো কপি-টপি দেখিয়ে জিনিসটাকে ছোট আকারেই মিটিয়ে নেওয়া যাবে।’
সেই একশো কপি, এবং তার পর আটত্রিশটি বছর। অতঃপর, রবীন্দ্রনাথের জন্মসার্ধশতবর্ষে সেই অনুবাদকের ফের মনে পড়ল পুরনো অনুবাদটির কথা। অধিকাংশ লোকই চর্বিত চর্বনে ব্যস্ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ততটা-জনপ্রিয়-নয় এমন কিছু কাজ যদি ফিরে দেখা যায়!
যদি, সেই সব কবিতার সঙ্গে দেখা দেয় ছবি। অর্থাৎ, পেন্টিং! সেই শব্দ ও ছবির যুগলবন্দি নিয়েই সিমা গ্যালারিতে, ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে প্রদর্শনী ‘শেষ লেখা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিম কাব্যগ্রন্থটির পনেরোটি কবিতার অনুবাদ, সঙ্গে ছবি। কিংবদন্তী এক কবি-চিত্রীকে স্মরণের চিত্ররূপময় আয়োজন। |
|
‘শেষ লেখা’র তৃতীয় কবিতা অবলম্বনে পরেশ মাইতির আঁকা নিসর্গ। |
‘একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এই সব কবিতার মধ্যে অনেক ‘ইমেজ’ আছে, যাকে ‘ভিস্যুয়াল এলিমেন্ট’ বলে, তেমন অনেক ইশারা লুকিয়ে আছে শব্দের ভাঁজে ভাঁজে...মনে হল, যদি সেই ছবিগুলোকেও ধরা যায়। ল্যান্ডস্কেপ। তখনই পরেশের কথা ভাবলাম।’ পরেশ মাইতি। এবং তাঁর জলরং। এই নির্বাচন, প্রীতীশ জানাচ্ছেন, অনিবার্য। ‘কারণ, পরেশের আঁকা নিসর্গের জোরটা হল আশ্চর্য একটা সারল্য। কায়দার মারপ্যাঁচ নেই, হৃদয় আছে, আর জলরং-এ ওঁর দক্ষতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।’
পাশাপাশি, পরেশ মাইতির ব্যস্ততার কথাও সর্বজনবিদিত। সুতরাং, আশ্চর্য নয় যে একবার মুম্বই বিমানবন্দরে আচমকা পরেশ-প্রীতীশ সাক্ষাৎ হবে, সেখানে উসকে উঠবে এই যৌথ প্রকল্পের আগুন, কথা আগেও হয়েছিল, কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারে তা আরও একটু এগোল, পরেশের সারাক্ষণের লাগেজ-এ এল প্রীতীশের সেই ক্ষীণতনু অনুবাদ-বই, সেই সব কবিতায় ডুব দিলেন পরেশ।
‘তার পর, প্রীতীশদার সঙ্গে বসলাম। একটি একটি করে কবিতা নিয়ে কথা হল। ভাবনা চালাচালি হল। মনের মধ্যে একটা আলো জ্বলে উঠল যেন।’ বললেন পরেশ।
সেই আলো থেকেই ক্রমে জন্ম নিল অন্ধকার। মধ্যরাতের অন্ধকার। মিডনাইট ব্লু। কখনও ছবিতে দেখা দিল ভোরের আলো, মেঘের ফাঁকে। পাখিরা ডানা মেলল আকাশে। কখনও চওড়া আকাশের নীচে নীলচে আঁধার শুয়ে থাকল নিঃসঙ্গ নৌকা। কখনও দুয়েকটি তারা দেখা দিল আকাশে। বা সন্ধ্যার লালচে দিগন্তের দিকে এগোল কিছু তরণী।
‘এ সব কি শুধুই মৃত্যুর রূপক? আমি তো বলব, এই কবিতাগুলি যতটা মৃত্যুকে ছুঁয়ে আছে, ততটাই জীবনেরও কাছাকাছি। সেটাই এই সব কবিতার নিহিত আলোছায়া।’ বলছেন প্রীতীশ। ‘যেখানে রূপনারাণের কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা কি নির্দিষ্ট কোনও একটি নদী, নাকি এমন কোনও স্রোত যা বয়ে চলে অনন্তকাল?’, বলছেন পরেশ।
|
|
জীবন আর মৃত্যুর মোহনায় দাঁড়িয়ে লেখা কবিতার চিত্রায়ণে যে জড়িয়ে যাবেই শুরু এবং শেষ, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। শুধু এইটুকু খেয়াল করা জরুরি যে, ছবিগুলির মধ্যে কোথাও পূর্ণচ্ছেদ পড়ে না, শেষ হয় না যেন...। ঠিকই, একটি মুহূর্ত কাগজের পটে স্থির হল, ফ্রেম-বন্দি হয়ে উঠে এল দেওয়ালে, কিন্তু সেই দৃশ্যত স্থাণু চিত্রপটেও থেকে গেল একটি চলাচলের ইঙ্গিত। এই সব কবিতা এক-একটি অভিযাত্রার মতো যেন, অনন্তের সঙ্গে যেন কথা বলছেন কবি, সেই ভাবটাই ধরা দিয়েছে ছবিতে। গ্যালারির দেওয়ালে ছবির পাশেই থাকছে তারা, কালি-কলমের আঁচড়ে, যার পোশাকি নাম ক্যালিগ্রাফি। সেগুলি প্রীতীশেরই স্বহস্তনির্মিত। ‘আমরা লিখতে ভালবাসতাম। মোবাইলে টেক্সট করা নয়, হাতে লেখা। প্রেমপত্র লিখতাম। জীবনের নানা অনুভূতি যে হস্তাক্ষরে ধরে রাখা যায়, তেমন একটা বিশ্বাসটা ছিল। এই লেখাগুলো ওই ভাবেই...’, হাসছেন প্রীতীশ, ‘আর, প্রকৃত অনুবাদক তো আসলে বিশ্বাসঘাতক, সে মূল রচনায় অন্তর্ঘাত ঘটায়, নিয়ে আসে নিজের ভাবনাচিন্তা, নিজস্ব আলো, অন্ধকার...’
আটত্রিশ বছর আগে যে সব অনুবাদ করেছিলেন, সেগুলিই রেখে দিয়েছেন প্রীতীশ। এখন করলে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে ভাবতেন, জানাচ্ছেন নিজেই, কিন্তু তাতে সেই ঝোড়ো দিনগুলি রাতগুলির ছাপ থাকত না আর। তা হলে কি, সিমা-র এই প্রদর্শনীতে এই প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে ফেলে-আসা আর এক প্রীতীশের দেখা হবে? ‘অবশ্যই। এই সব অনুবাদে সেই প্রীতীশের ছাপ লেগে আছে। পৃথিবীটা বদলেছে, ভাল-মন্দের বোধও পাল্টেছে বিস্তর, ভাবলাম, এই সময় ‘শেষ লেখা’র সেই অনুবাদগুলি ফিরিয়ে আনি! তাই, নতুন করে অনুবাদ করিনি।’
ফিরলও তারা। শব্দে এবং দৃশ্যে। ফিরে এল পুরনো সময়। অস্থির হল রবি ঠাকুরের ছবির সামনে জমে ওঠা নিথর সব মালা। |
|
|
|
|
|