আদিম ও আধুনিকের বিরল সহাবস্থানের নাম ভারতীয় সভ্যতা। তাই নয়ডায় রুদ্ধশ্বাস গতির মোটরযানগুলি যখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে গড়া ‘ফর্মুলা-ওয়ান’ প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হইতেছে, তখনও তাহার অদূরে শত-সহস্র শম্বুক গতির গো-শকট ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ তুলিয়া অলস মধ্যাহ্নে খড়ের বোঝা লইয়া স্থানান্তরে ভ্রাম্যমাণ। কত কাল হইল এই গো-শকটগুলি ভারতের মাটিতে চলিতেছে? মহেঞ্জোদরোর সুপ্রাচীন কাল হইতে। এখন তাহারই অনতিদূরে ফর্মুলা ওয়ানের মসৃণ ও পিচ্ছিল পথ নির্মিত হইলেও গো-শকটকে ভারতীয় সভ্যতা হইতে এখনও নির্বাসিত করা গেল না।
তবে শুধু গো-শকট কেন, সনাতন ভারতের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদানও তো এই একুশ শতকেও রহিয়া গিয়াছে। সতীদাহ হয়তো বন্ধ হইয়াছে, হয়তো, কিন্তু সতী-মন্দিরে আজও পুণ্যার্থীদের সমাগম। যাঁহারা সরজমিনে ভারতে পর্যটন বা সফরে আসেন, তাঁহারা বেঙ্গালুরুর সিলিকন ভ্যালি, হায়দরাবাদের সাইবার চমৎকার, মুম্বই-দিল্লির বহুতল-বিলাস দেখিয়া হয়তো বুঝিতে পারিতেছেন, ভারত ঔপনিবেশিক যুগের পশ্চাৎপদতা হইতে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁহারা কুম্ভ মেলার ধর্মোন্মাদনা, নিম্নবর্গীয়ের অস্পৃশ্যতা, মন্ত্রী-নেতাদের সাধুসঙ্গ, বাবা-ব্রহ্মচারীদের আশীর্বাদ ও বিভূতি বিতরণের দুর্জ্ঞেয়বাদী ক্রিয়াকলাপও প্রত্যক্ষ করেন। ফলে ভারত সম্পর্কে এক মিশ্র, জগাখিচুড়ি ধারণা লইয়া তাঁহারা ফিরিয়া যান। ভারত কি পরমাণু বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের আধুনিক প্রযুক্তির দেশ, না কি গরুর গাড়ি, কুটির শিল্প, তুলসী মঞ্চ আর উঠানে লক্ষ্মীর পদচ্ছাপ সম্বলিত আলপনা আঁকার সনাতনভূমি? না কি ভারত এ দুইয়েরই সংশ্লেষ? ইন্ডিয়া এবং ভারত-এর বিপরীত-সমাহার সম্ভবত কোনও দিনই ঘুচিবার নয়। |
ফর্মুলা-ওয়ানে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরাও সম্ভবত এ ধরনের বিভ্রমে আক্রান্ত হইয়াছেন। তাই সুইজারল্যান্ডের প্রতিযোগী দলটি অংশগ্রহণের আগেই তাঁহাদের গাড়িগুলির যথাবিহিত পূজার্চনা করার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। দায়সারা বা প্রতীকী পূজা নয়, রীতিমত পুরোহিত ডাকিয়া, বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করিয়া, গাঁদা ফুলের মালা পরাইয়া এবং গাড়ির বনেটে সিঁদুরের টিপ পরাইয়া পুরাদস্তুর পূজা হইতে চলিয়াছে। একই সঙ্গে শাশ্বত-সনাতন এবং আধুনিক গতিময় এই ভারত অনেককেই বিমূঢ় করে। তাঁহারা ভাবিয়া পান না, কেমন করিয়া একটি দেশে একই সঙ্গে এতগুলি শতাব্দী, অতগুলি সভ্যতা এ ভাবে সহাবস্থান করিতে পারে! প্রকৃতিতে দেখা যায়, পুরাতনের ধ্বংসের মধ্য দিয়াই নূতনের জন্ম হয়, প্রবীণকে বহিষ্কার করিয়াই নবীন আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করে। দুনিয়ার নানা ভূখণ্ডেও সচরাচর তাহাই দেখা যায়। ভারত যেন ব্যতিক্রম। এখানে নূতনের পাশে পুরাতনও খানিক স্থান করিয়া লয়, নবীনের অভিষেকের জন্য প্রবীণকে গলা-ধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দেওয়া হয় না। অন্তর্ভুক্তির এই ধারা ভারতের সমাজে, সংস্কৃতিতে, লোকাচারে, ধর্মে সর্বত্র বিরাজিত। ইহাই আবহমান ভারত। |