|
|
|
|
কাশীপুরে নয়, দক্ষিণেশ্বরেই
শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন |
কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ উৎসাহ দেখাননি রামকৃষ্ণের
সেই আবেদনে। লিখছেন শংকর। শেষ কিস্তি |
শোনা যায়, চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুর এবং কাশীপুরে এসে এক সময় অসুস্থ রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ফেরবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মন্দির-কর্তৃপক্ষ তাতে উৎসাহ দেখাননি। কাশীপুরে দেহাবসানের পরও গোলমাল। শ্রীমা তখন নিঃস্ব। মাকে ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস মাসে পাঁচ-সাতটি করে টাকা দিতেন। তিনি যখন বৃন্দাবনে তখন ভাইপো রামলাল বাগড়া দিলেন, খাজাঞ্চিদের বললেন, মা ভক্তদের কাছ থেকে যা পান তা একজন নিঃসন্তান বিধবার পক্ষে যথেষ্ট। কালীবাড়ির টাকা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এই টাকা যাতে বন্ধ না হয় তার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
দক্ষিণেশ্বরে বসবাসকালে শ্রীরামকৃষ্ণের তিনটি সাক্ষাৎকার অক্ষয় স্থান অধিকার করে রয়েছে। এঁদের একজন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, আরেক জন অনন্য সাধক ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন এবং তৃতীয় জন মাস্টারমশায় মহেন্দ্রনাথ গুপ্তশ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের মাধ্যমে যিনি রামকৃষ্ণকে বিশ্বজনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রাণপুরুষ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে প্রথম দেখা জয়গোপাল সেনের বাগানবাড়িতে। তার পর দক্ষিণেশ্বরে উভয়ের মধ্যে গভীর অন্তরঙ্গতার সূচনা। কেশবই প্রথম বহির্বিশ্বে ঠাকুরের কথা প্রচার করেন। তাঁর বাড়িতেই ঠাকুরের প্রথম ফটো তোলা। নতুন ভারতের সঙ্গে ঠাকুরের সেতুবন্ধন এই কেশবের মাধ্যমে। ঠাকুরের জীবিতকালে কেশবের সংকলিত ‘পরমহংসের উক্তি’ পরবর্তী সময়ের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের পথপ্রদর্শক।
ঠাকুর বুঝেছিলেন, কেশব আসার পরেই ইয়ং বেঙ্গল-রা দক্ষিণেশ্বরে আসতে শুরু করেন। তবে সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাৎ নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। প্রথম দূর থেকে দেখা ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতেযেখানে নরেন্দ্রনাথ ভজন গাইবার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আঠারো বছরের নরেন্দ্রনাথকে দেখে ঠাকুর খুশি হন এবং একদিন তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যেতে বলেন। এ সম্বন্ধে ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দ নিবিড় ভাবে লিখে গিয়েছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণকে আমি প্রথম দর্শন করি দক্ষিণেশ্বরে তাঁর নিজের ঘরে। সেদিন আমি দুটি গান গেয়েছিলাম।” পরবর্তী বর্ণনা এক ইতিহাসের অঙ্গ, স্বামীজির শ্রীমুখনিঃসৃত...“আমি তাঁহার দিকে আগাইয়া গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর দশর্ন করেছেন?’ তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘হাঁ আমি ঈশ্বর দর্শন করেছি। ঠিক যেমন তোমাকে দেখছি, তবে এর চেয়েও আরো ঘনিষ্ঠরূপে।’ শুরু হয়ে গেল এক নতুন যুগের নতুন ইতিহাস।
নরেনের দ্বিতীয় দর্শনও দক্ষিণেশ্বরে। পরবর্তী কালে দক্ষিণেশ্বরের স্মৃতিমন্থন করে নরেন্দ্রনাথ বলেছেন, “ঠাকুরের নিকট কি আনন্দে দিন কাটতো, তা অপরকে বোঝানো দুষ্কর। খেলা, রঙ্গরস প্রভৃতি সামান্য দৈনন্দিন ব্যাপারের মধ্য দিয়ে তিনি কিভাবে নিরন্তর উচ্চশিক্ষা প্রদান করে আমাদের অজ্ঞাতসারে আমাদের অধ্যাত্মজীবন গঠন করিয়ে দিয়েছিলেন, তা এখন ভেবে বিস্ময়ের অবধি থাকে না।”
নরেন একবার দক্ষিণেশ্বর থেকে যাওয়ার সময় ঠাকুরকে বলেছিলেন, বুধবার তিনটের সময় আসব। কিন্তু একটু আগেই এসে যাওয়ায় দুপুর দুটো থেকে সদর ফটকে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরে ঠিক সময়ে ঠাকুর চটিজুতো পরে হনহনিয়ে সদর ফটকে গিয়ে দেখেন, নরেন দাঁড়িয়ে আছেন। শুনলেন, সত্য রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, তিনটে বাজলে ঢুকবেন। খুশি হলেন ঠাকুর, প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে ঠিক তিনটের সময় ঘরে ঢুকলেন। যখনকার যা তা না করা, ঠিক সময়ে কাজ সেরে না রাখা, সময়ানুবর্তিতা এ সব ছিল গুরু-শিষ্যের স্বভাবে।
‘লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট’ কথাটির শ্রেষ্ঠ দক্ষিণেশ্বরী উদাহরণ হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের অবিস্মরণীয় লেখক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। দক্ষিণেশ্বরে প্রথম দর্শন ১৮৮২ সালে এবং ১৮৮৬ সালের ১৬ অগস্ট কাশীপুরে মহাসমাধির দিন পর্যন্ত প্রায় নিত্যপরিচয়। এই পরিচয় থেকেই ইদানীং কালের বিস্ময়কর বই কথামৃত। মনের দুঃখে মাস্টারের আত্মহত্যার ইচ্ছা হল, সেই মন নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিতি, তার পর তো সব ইতিহাস।
কেউ কেউ বলেন, রামায়ণ মহাভারতের পরে ভারতীয় সাহিত্যে কথামৃতের মতন এমন বেস্ট সেলিং বই আর লেখা হয়নি। সময় পেলেই শ্রীম দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন এবং যে বিপুল নিষ্ঠায় ঠাকুরের কথাবার্তা লিপিবদ্ধ করেছেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। এই বই দিয়েই যে বিশ্ববাসী ঠাকুরের বাণীর সঙ্গে আজও পরিচিত হয়ে চলেছে, তা বলা অত্যুক্তি হবে না। শ্রীমা-র কথায়, “ঠাকুর নিজের জীবন দিয়ে মনুষ্যজীবনের সকল সমস্যার সমাধান করে গেছেন।” ঠাকুরের এক একটি কথা মহা মন্ত্র। এর একটি জপ করলে সিদ্ধ হয়ে যায়। তাঁর প্রার্থনাও মন্ত্র। তিনি প্রার্থনা করেছিলেন, ‘মা, এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য। তোমার পাদপদ্মে শ্রদ্ধাভক্তি দাও। এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম। মা, এই নাও তোমার ভাল, এই নাও তোমার মন্দ, তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধা ভক্তি দাও।” |
|
দক্ষিণেশ্বরের কথাবার্তা শ্রীমা স্মৃতিতে বহন করে আনতেন, বাড়িতে বসে সযত্নে ডায়েরিতে সংক্ষিপ্ত নোট লিখে রাখতেনকখনও সারা রাত জেগে। অনেক সময় এক দিনের কথার নোট সাত দিন ধরে স্মৃতি থেকে বার করে লিখতেন। পণ্ডিতেরা জানেন, ঠাকুরের দেহাবসানের বহু বছর পরে বাংলা কথামৃতের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়, বাকি খণ্ডগুলি প্রকাশিত হতে সময় লাগে আরও তিরিশ বছর। কথামৃতের কথাকার সশরীরে দক্ষিণেশ্বরে না এলে আমরা ঠাকুরের স্মৃতি এই ভাবে ধরে রাখতে পারতাম না। শ্রীমা বলেছেন, “আমি নগণ্য লোক, কিন্তু সমুদ্রের ধারে বাস করি, আর নিজের কাছে কলসিতে সমুদ্রের জল ভরে রাখি। ঠাকুরের কথা ছাড়া আর কি বলবার আছে আমার? আমার জীবনের গ্রেটেস্ট ইভেন্ট যদি জিজ্ঞেস করেনতা হচ্ছে পরমহংসদেবের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে সাক্ষাৎ।” শুধু একজন লেখকের পক্ষে নয়, যে মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে ‘যত মত তত পথ’ নামক মহাবাণী প্রথম উচ্চারিত হয়, এ কালের মানুষের পক্ষেও তার থেকে অবিস্মরণীয় ইভেন্ট আর কী হতে পারে?
আরাধ্যা দেবী, ভক্তজনদের প্রতি বরাভয়, দাম্পত্যজীবনে নির্ভয় পরীক্ষানিরীক্ষা, শ্রেষ্ঠ শিষ্যের অনুসন্ধান এবং অনন্তকালের সত্যগুলিকে সহজ ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মতো কত কাজই দক্ষিণেশ্বরের তিন দশকে মন্দিরের মাইনে-করা পুরোহিত কী ভাবে করলেন, তার একটা ছবি তো পাওয়া গেল। কিন্তু তাঁর দৈনন্দিন অভাবী জীবনের একটা ছবিও তো জানতে ইচ্ছে করে কৌতূহলীদের। তাঁর মেজদা রামেশ্বরের বড় ছেলে রামলাল চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে তিনি ‘রামনেলো’ বলে সস্নেহে ডাকতেন, তিনি কিছু বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ রেখে গিয়েছেন।
দক্ষিণেশ্বরে ভোর তিনটে-সাড়ে তিনটেয় উঠেই রামকৃষ্ণ ঝাউতলায় শৌচে যেতেন, রামলাল গাড়ু-গামছা নিয়ে পিছুপিছু যেতেন। তার পর পুকুরের ধারে কাপড় ছেড়ে ঘাটের ওপর তিনি পা ঝুলিয়ে বসতেন। মুখ-হাত-পা ধুতেন, তার পর গামছা পরে ঘরে ফিরে আসতেন। ঘরে ফিরে রামকৃষ্ণ কাচা কাপড় পরতেন এবং দক্ষিণের বারান্দায় দাঁত মেজে, হাতের চেটোয় একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে বলতেন, “ব্রহ্মবারি, ব্রহ্মবারি! গঙ্গা, গঙ্গা! হরি ওঁ তৎসৎ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ তার পর জগন্নাথ ও কালীর প্রসাদ খেতেন, সেই সঙ্গে তারকেশ্বর মন্দিরের শুকনো বেলপাতা। এ বার ঘরের দেবদেবীর চিত্রগুলিকে একে একে প্রণাম করে নিজের খাটটিতে বসা। ঠাকুরের সারা দিনের কার্যক্রম জানতে যাঁদের আগ্রহ, তাঁদের জন্য তো রয়েছে বহু খণ্ডের ‘কথামৃত’ ও ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ এবং সেই সঙ্গে ইদানীং সাড়া-জাগানো সারদামণির নানা স্মৃতিকথা।
কিন্তু আজও দূরদূরান্তেও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাঁচ টাকা মাইনের পূজকের এত প্রভাব কেন? এ বিষয়ে শত-সহস্র পাতা অবশ্যই লেখা হয়েছে, কিন্তু আমার ভাল লাগে অর্থনীতির অধ্যাপক বিনয় সরকারের কয়েকটি মন্তব্য। আমাদের অনেকের বিশ্বাস, দক্ষিণেশ্বরের পূজক “বাঙালীকে আর দুনিয়াকে স্বর্গের পথ বাৎলাইয়া গিয়াছেন,...যাহারা রামকৃষ্ণ মিশনের মক্কেল তাহারা বুঝি স্বর্গলোভী মানুষ, মোক্ষ-পাগলা নরনারী,...রামকৃষ্ণ পাটের দালাল ছিলেন না।...কোন ইস্কুল-পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা অথবা ইন্সপেক্টর-রূপে রামকৃষ্ণ পরিচিত ছিলেন না,...অধিকন্তু লম্বা-চওড়া বিশ্বকোষ তাঁহার মাথা হইতে বাহির হইয়া আসে নাই....রামকৃষ্ণ কথার বেপারি।...এই কথাগুলিই মানুষকে চাঙ্গা করিয়া তুলিতেছে। দুনিয়ার নরনারীকে বাঁচাইয়া রাখিতে, বাড়াইয়া তুলিতে, বাড়তির পথ দেখাইয়া দিতে এই কথাগুলির ক্ষমতা অসীম। রামকৃষ্ণের কথাগুলিই বিপুল অমৃত।...রামকৃষ্ণ বাঙালী অবতার মাত্র নন, হিন্দু অবতার মাত্র নন। দুনিয়ার পৌরুষকামী, ব্যক্তিত্বপন্থী, স্বাধীনতানিষ্ঠ, চিত্ত-যোগী মানুষ মাত্রেই রামকৃষ্ণকে অবতাররূপে পূজা করিতে বাধ্য।” এই হল আন্তর্জাতিক নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত বিনয় সরকারের মতামত।
আর শ্রীরামকৃষ্ণের পটভূমি? একবার সিস্টার নিবেদিতা নিচু গলায় যা বলেছিলেন তা মনে এসে যায়, “দক্ষিণেশ্বর মন্দির ছাড়া আমরা রামকৃষ্ণকে পেতাম না, রামকৃষ্ণ ছাড়া আমরা বিবেকানন্দকে পেতাম না এবং বিবেকানন্দ ছাড়া পেতাম না বিশ্বব্যাপী ছড়ানো রামকৃষ্ণ মিশনকে।” দক্ষিণেশ্বর পর্ব সম্পর্কে নিবেদিতার এই স্মরণীয় মন্তব্যের সঙ্গে শুধু জুড়ে দিতে ইচ্ছে করে শ্রীম রচিত আশ্চর্য বই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের কথা।
|
গত সংখ্যা: মাসমাইনে পাঁচ টাকা |
|
|
|
|
|