প্রতিশ্রুতির দৌড় কাগজে-কলমেই।
রাজ্যে শিশুমৃত্যু বন্ধে জেলায় জেলায় নবজাতকদের চিকিৎসার জন্য ‘সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ) খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট কুড়িটা এ ধরনের ইউনিট খোলার কথা ছিল। ঘোষণার পরে তিন মাস কেটে গিয়েছে। প্রতিশ্রুত একটা ইউনিটও দিনের আলো দেখেনি।
এমনকী, রাজ্যে শিশুদের জন্য সবেধন নীলমণি ‘রেফারেল’ হাসপাতাল যেটা,খাস কলকাতার সেই বিসি রায় শিশু হাসপাতালেও নয়!
অথচ গত জুলাইয়ে এই বিসি রায়েই এক দিনে ১৮টি শিশুর মৃত্যুর পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে এক মাসের মধ্যে চল্লিশ শয্যার পূর্ণাঙ্গ এসএনসিইউ খোলা হবে। তা এখনও হয়ে ওঠেনি। কবে হবে, সে সম্পর্কে স্বাস্থ্য-কর্তারাও কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। কিন্তু ঘোষণা সত্ত্বেও জেলার হাসপাতালগুলোয় এসএনসিইউ হচ্ছে না কেন?
স্বাস্থ্য-কর্তারা নানাবিধ যুক্তি দিচ্ছেন। যেমন: যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার-নার্স নেই, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের বন্দোবস্ত হয়নি, এমনকী বহু জায়গায় পূর্ত দফতর ওই ইউনিটের জন্য আলাদা ঘরই বানাতে পারেনি বলে ওঁদের অভিযোগ। বস্তুত জেলা হাসপাতালে এসএনসিইউ তৈরির জন্য যত না উদ্যোগ চোখে পড়ছে, কর্তারা তার চেয়ে বেশি সরব জেলা থেকে কলকাতায় রোগী পাঠানোর ‘প্রবণতা’র সমালোচনায়। অথচ জেলায় উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে না-উঠলে এই প্রবণতা ঠেকানো যাবে কী করে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এরই প্রেক্ষিতে অনেকে পরিস্থিতিটাকে ‘গাছের গোড়ার যত্ন না-নিয়ে আগায় জল দেওয়ার চেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করছেন। যেমন বুধবার বিসি রায়ে যে দশটি শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে, তাদের ছ’জনকেই অন্যান্য জেলা থেকে কলকাতায় রেফার করা হয়েছিল। ছ’টিই ছিল রুগ্ণ নবজাতক। এবং জেলা হাসপাতালে এসএনসিইউ না-থাকার কারণেই যে
তাদের কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল, প্রাথমিক তদন্তে তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
আর এই তথ্যটি প্রকাশ্যে আসার পরেই জেলায় জেলায় এসএনসিইউ তৈরির জন্য স্বাস্থ্যভবনে ফের ফাইল চালাচালি শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। বিসি রায়ের ঘটনার তদন্তে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের গড়া চার সদস্যের কমিটি এ দিনই স্বাস্থ্য দফতরে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। দফতর সূত্রের খবর, চিকিৎসায় গাফিলতির কোনও প্রমাণ না-মিললেও অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে শিশুরা যে মুমূর্ষু অবস্থাতেই বিসি
রায়ে পৌঁছেছিল, সেটা ধরা পড়েছে তদন্তে।
এসএসকেএমের ইউনিটটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আপাতত এসএনসিইউ আছে ছ’টি। আরও কুড়িটা হলে সংখ্যাটা দাঁড়াবে ২৬, যা মোটামুটি ভাবে এ রাজ্যের রুগ্ণ নবজাতকদের জন্য পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা-পরিকাঠামো হিসেবে গণ্য হতে পারে। বর্তমানে পরিকল্পনাটির ভবিষ্যৎ কী?
রাজ্যের উপ স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “আমাদের পরিকল্পনা তো সুদুরপ্রসারী। কিন্তু লোকবল ও অন্যান্য কিছু সমস্যার জন্য তা বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না। তবে আমরা কয়েকটা অভিনব ব্যবস্থা নিচ্ছি।” কী রকম? বিশ্বরঞ্জনবাবু জানান, এসএসকেএমে রাজ্যের প্রথম নবজাতক পরিচর্যাকেন্দ্রের সঙ্গে বাঙুর হাসপাতালকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। বাঙুরের এসএনসিইউ-কে এসএসকেএমের ‘স্যাটেলাইট সেন্টার’ করা হবে। এর ফলে এসএসকেএমে ভর্তি রুগ্ণ নবজাতেরা একটু স্থিতিশীল অবস্থায় এলে তাদের বাঙুরে পাঠানো হবে। কিংবা এসএসকেএমে যাদের ঠাঁই হবে না, তাদের জন্য বরাদ্দ হবে বাঙুরের শয্যা। স্বাস্থ্য-কর্তাদের দাবি: এটা চালু হলে অসুস্থ বাচ্চাদের নিয়ে মা-বাবার হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘোরাও অনেকটা বন্ধ হবে। গোটা ব্যবস্থাটির দায়িত্বে থাকবেন এসএসকেএমের বিশেষজ্ঞ নবজাতক-চিকিৎসকেরা।
আর বিসি রায়ে নতুন এসএনসিইউ করার কী হবে? হাসপাতালের অধ্যক্ষ মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওটা চালু হওয়াটা খুব জরুরি। কিন্তু সবটা তো আমাদের হাতে নেই! তা-ও আশা করছি, অল্প কিছু দিনের মধ্যে অন্তত কয়েকটা বেড চালু করা যাবে।” জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য-অধিকর্তা দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, “আমরা ধাপে ধাপে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এসএনসিইউ খোলার চেষ্টা করছি। খুব তাড়াহুড়ো করে এ সব হয় না। একবার চালু হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লে সমস্যা আরও বাড়বে। আশা করছি, চলতি আর্থিক বছরের মধ্যে সব ক’টা এসএনসিইউ-ই চালু হয়ে যাবে।”
প্রতিশ্রুতির বেড়া ডিঙিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবের মুখ কবে দেখবে, সেটাই দেখার।
|