বেশির ভাগ এলাকায় অন্য বারের থেকে অনেকটাই স্তিমিত। কিন্তু খোদ বাঁকুড়া শহরেই শব্দবাজির দাপাদাপি রুখতে পারল না পুলিশ। মাঝরাত অবধি না গড়ালেও বোমা-পটকার আওয়াজে বারংবার পিলে চমকে উঠল শহরের বেশ কিছু এলাকার মানুষের।
বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বেশির ভাগ এলাকাতেই অবশ্য এ বার শব্দবাজিকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে রংবেরংয়ের আতসবাজি। স্বস্তি পেয়েছেন অনেকে। হাঁফ ছেড়েছে পুলিশ প্রশাসনও। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রণব কুমার বলেন, “বাঁকুড়া শহরের কোনও এলাকায় শব্দবাজি ফেটেছে কি না জানা নেই। পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ হয়নি।”
একই ছবি পুরুলিয়া জেলাতেও। ফি বছর দীপাবলির সময় শব্দবাজির যে দাপট দেখতে অভ্যস্ত রেল শহর আদ্রা, শিল্প শহর রঘুনাথপুর থেকে শুরু করে পুরুলিয়া সদর বা কাশীপুর, এ বার সেই অর্থে কিছুটা ‘ব্যতিক্রমী’ কালীপুজো দেখলেন এই জেলার বাসিন্দারা। বস্তুত, গত বছর থেকেই শব্দবাজির দৌরাত্ম্য কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। এ বার এখানেও শব্দবাজিকে হারিয়ে দিল বাহারি আলোর ফুলকি। |
কিন্তু শব্দবাজি একেবারে বাজার থেকে উবে গিয়েছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বিক্ষিপ্তভাবে দুই জেলারই বিভিন্ন এলাকায় বুধবার রাত বাড়তেই শোনা গিয়েছে চকোলেট বোমা ও কালীপটকার বেশ জোরালো আওয়াজ।
বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, বাঁকুড়া শহরের কলেজ মোড়, শিখোরিয়া পাড়া, লালবাজার, পোদ্দার পাড়া প্রভৃতি এলাকায় রাতে শব্দবাজি ফাটানো হয়েছে। বাঁকুড়া জেলার অন্যান্য এলাকাতেও এমনই শব্দবাজি ফাটানোর বিক্ষিপ্ত ঘটনা রয়েছে। যেমন, মহকুমা শহর খাতড়ায় শ্মশানকালী মন্দির লাগোয়া এলাকায় আতসবাজির সঙ্গে শব্দবাজি ফেটেছে। তবে তা গতবারের তুলনায় বেশ কম ছিল। এই শহরে কালীপুজোর বেশ জাঁকজমক রয়েছে। পুরনো বাজার, কংসাবতী রোড, হাইস্কুল মোড়, করালি মোড় এলাকায় শব্দবাজি ফাটানো হয় বলে অভিযোগ। তবে, তুবড়ি, রং মশাল প্রভৃতি আতসবাজিও দেখাও দিয়েছে। খাতড়া হাইস্কুলের শিক্ষক সুবীর মণ্ডল বলেন, “মানুষ সচেতন হয়েছেন। অন্য বছর শব্দবাজির শব্দে কান ঝালাপাল হয়ে যেত। এ বছর মানুষ শব্দবাজি ছেড়ে আতসবাজিতে মেতেছে দেখে ভাল লাগল। এটা ভাল লক্ষণ।”
বিষ্ণুপুর শহরেও এ বার শব্দবাজি তুলনায় কম ফেটেছে। কালো আকাশের বুকে মাঝে মধ্যেই আতসবাজির আলোর বিন্দু ছড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে। বাড়ির উঠোনে কচি-কাঁচাদের তুবড়ি, ফুলঝুরি জ্বালাতে দেখা গিয়েছে। বাঁকুড়া শহরের প্রবীণ বাসিন্দা পরিবেশকর্মী দেবী পালিত বলেন, “আমাদের মতো বয়স্করা শব্দবাজির জন্য খুব কষ্ট পেতাম। এ বার শব্দবাজি কম ফেটেছে। কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।” একই কথা শোনা গিয়েছে মাইক, সাউন্ড বক্স ও শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে এত দিন সরব থাকা মধুসূদন দরিপার গলায়। তিনি বলেন, “আগের থেকে এ বার বাজি-পটকা কম ফেটেছে। এটা ভাল দিক।” |
এ বার বাজি কম ফাটার কারণ কী? পুলিশের দাবি, শব্দবাজির বিরুদ্ধে কালীপুজোর অনেক আগে থেকেই পুলিশকর্মীরা অভিযান চালিয়েছে। কয়েক দিন আগে বাঁকুড়া শহরে ৭৫ কিলোগ্রাম নিষিদ্ধ শব্দবাজি সহ এক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার আগে বিজয়া দশমীর দিন মাচানতলায় দুর্গা প্রতিমার ভাসানের শোভাযাত্রা থেকে নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগে পুলিশ লাঠি চালায়। জনতা-পুলিশ খণ্ডঝুদ্ধ হয়েছিল। বেশ কিছু শব্দবাজিও আটক করা হয়। বাসিন্দাদের একাংশের মতে এ সব কারণে এ বার শব্দবাজি ফাটানোয় কিছুটা লাগাম ছিল।
পুরুলিয়া জেলায় গত বছর শব্দবাজি না ফাটানোর জন্য পুলিশ প্রচার চালিয়েছিল। এ বার পুলিশ শব্দবাজির বিরুদ্ধে ধরপাকড়ে জোর দিয়েছিল। এমনকি পুলিশ কর্মীরা ছদ্মবেশেও বিভিন্ন জায়গায় হানা দেন। পুরুলিয়া মফস্সলের চাষমোড় ও পুরুলিয়া শহর থেকে দু’জনকে বেআইনি শব্দবাজি মজুত করার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। প্রচুর বাজিও আটক হয়। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ নজরদারিও চালিয়েছে। -কালীপুজোর রাতে পাড়া থানার আনাড়া থেকে নিষিদ্ধ শব্দবাজি বিক্রি করার অভিযোগে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করে। সেখানেও শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এর ফল মিলেছে কালীপুজোর রাতে।
পুরুলিয়া শহরের রাঁচি রোডের বাসিন্দা তরুণী মৌসুমী সেনের কথায়, “অন্য বার শব্দবাজির দৌরাত্ম্যে কান ঝালাপাল হয়ে যেত। কালীপুজোর রাতে রাস্তায় পথে বের হলে রাস্তার পাশে পটকা ফাটানো দেখতে পেতাম। ভয় হত পটকার আগনের ফুলকি ছুটে এসে পোশাক পুড়িয়ে না দেয়! এ বার সে অভিজ্ঞতা হয়নি।” ফি বছর কালীপুজোর রাতে আতসবাজির প্রদর্শনীর আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ। সেখানকার শিক্ষক শ্যামল মণ্ডল বলেন, “পুরুলিয়া শহর ও লাগোয়া এলাকায় এ বার শব্দবাজির দাপট অনেকটাই কম ছিল। বাজারেও দেখেছি বাজি বিক্রেতারা ক্রেতাদের সাফ জানিয়ে দিচ্ছিলেন, এ বার শব্দবাজি বিক্রি করা হচ্ছে না।”
আদ্রা, রঘুনাথপুর কিংবা সাঁওতালডিহিতেও গতবারের তুলনায় এ বার বাজি কম ফাটানো হয়েছে। বেশি রাতে পুজোর সময় কিছু এলাকায় বাজি ফাটলেও তা বেশি ক্ষণ হয়নি। বাজি ফাটানো নিয়ে মাতামাতিও তুলনায় কম ছিল। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আদ্রা, রঘুনাথপুর ও আনাড়ায় রাস্তার ধারে গত বছরেও নিষিদ্ধ শব্দবাজি বিক্রি করতে দেখা গিয়েছিল। এ বার তেমনটা দেখা যায়নি। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সুনীলকুমার চৌধুরী বলেন, “নিষিদ্ধ শব্দবাজি যাতে উৎসবের আনন্দ ম্লান না করে তাই আমরা এ বার অভিযানে জোর দিয়েছিলাম।” তবে, এই জেলায় শব্দবাজির প্রতিবাদ আজকের নয়। ২০০৭ সালে কালীপুজোর রাতে সাঁওতালডিহির অদূরে দেউলি গ্রামে শব্দবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ‘শহিদ’ হয়েছিলেন সুবোধকুমার মাহাতো। বাড়ির খানিক দূরে বাজি ফাটাচ্ছিলেন কয়েক জন। তিনি একা প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন। গনপিটুনির বলি হন তিনি। তাঁর ছেলে মানস এ দিন বলেন, “আজ বাবা বেঁচে থাকলে খুশি হতেন।” |