কালীপুজোর রাতে শব্দবাজির তাণ্ডব খাস কলকাতায় বেশি ছিল, নাকি শহরতলিতে, তা নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে। কিন্তু, স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রীর টহল, পুলিশের দৌড়োদৌড়ি এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকদের তৎপরতা সত্ত্বেও ‘শব্দদানব’কে যে আটকানো যায়নি, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। আর এই পরিস্থিতিতেই যে প্রশ্নটা উঠে আসছে, তা হল এত তৎপরতা, এত ব্যবস্থায় তা হলে কি কোথাও ফাঁক থেকে গিয়েছে?
পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলছেন, “এ বছর সরকার গঠনের পরে হাতে সময় ছিল নেহাতই কম।” কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা বলছেন, “কলকাতা পুলিশের সংযোজিত এলাকা থেকে শব্দবাজি ফাটার অভিযোগ অনেক বেশি পাওয়া গিয়েছে।” শব্দদূষণ আটকানোর প্রয়াসের সঙ্গে নিরন্তর জড়িয়ে আছেন যাঁরা, তাঁরা অবশ্য বলছেন অন্য কথা। তাঁদের বক্তব্য, সারা বছর ধরেই যদি সঠিক পরিকাঠামো নিয়ে শব্দমাত্রার উপরে নজরদারির প্রক্রিয়া চলে, কালীপুজোয় নিষিদ্ধ বাজি আটক বা শব্দদানবকে রুখে দেওয়াটা তা হলে সহজতর হয়।
তবে কি গলদ রয়েছে পরিকাঠামোতেই?
অন্যান্য বছরে শব্দবাজি বন্ধ করতে জুন-জুলাই মাসে তৎপরতা শুরু করে ‘স্টেট নয়েজ মনিটরিং কমিটি’। কালীপুজোর চার-পাঁচ মাস আগে থেকে হাসপাতালের কর্তাদের এবং পুরসভাগুলিকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বাজি ফাটার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। শিবকাশীর বাজি উৎপাদকদের চিঠি দিয়ে তাঁদের নিষিদ্ধ বাজির বিষয়ে ওয়াকিবহাল করা হয়। জেলার পুলিশকর্তাদের ডেকে নিষিদ্ধ বাজি উৎপাদনের উপরে নজর রাখতে বলা হয়। কারণ, বর্ষার পরেই এ রাজ্যে বাজি তৈরি শুরু হয়ে যায়। পর্ষদের সেই অভিজ্ঞতা এবং পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও এ বছর সে সব কাজের কোনওটাই হয়নি। কারণ, মনিটরিং কমিটির সদস্য-সচিব এবং পর্ষদের মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ ছুটিতে আছেন।
আর বিশ্বজিৎবাবুর অনুপস্থিতিটাই এ বারের লড়াইয়ে অনেকটা ফারাক গড়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর কথায়, “বিশ্বজিৎবাবু কেবল সদস্য-সচিব নন, তিনি এক জন সক্রিয় পরিবেশকর্মী। সেই জন্যই তাঁর অনুপস্থিতিতে পর্ষদের কাজের এতটা তারতম্য হয়ে গিয়েছে।” বস্তুত, রাত ১০টার পরে মাইক বাজানো বা শব্দবাজি ফাটানোর উপরে যে নিষেধাজ্ঞা আছে, পর্ষদ সেই আইন কঠোর ভাবে কার্যকর করলেই শব্দের তাণ্ডব থেকে খানিকটা অব্যাহতি মিলত। পর্ষদের কর্তারা সে দিকে নজরই দেননি। ফলে রাত বাড়ার সঙ্গে শব্দের তাণ্ডবও বেড়েছে। সরকারের হাতে সময় কম থাকার যুক্তি তাই মানছেন না ওয়াকিবহাল মহল। নাগরিক উদ্যোগে গঠিত ‘সবুজ মঞ্চ’-এর তরফে নব দত্তের বক্তব্য, “কেবল আইন আর পরিকাঠামো দিয়েই কাজ হয় না। চাই কাজের মানুষ। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে সেটারই অভাব। যখন শব্দবাজি বন্ধে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তখন পর্ষদ বাজি প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বাজির শব্দমাত্রা বাড়ানো যায় কি না, তা নিয়ে অকারণ আলোচনা করেছে। সেই ফাঁকে প্রচুর শব্দবাজি তৈরি হয়েছে। মজুত হয়েছে।” বুধবার রাতে তাঁরা মোট ১৪২টি অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন নববাবু। তার মধ্যে রাত ১০টার পরে এসেছে ৮২টি অভিযোগ।
তবে, বুধবার পরিবেশমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সুদর্শনবাবু বলেন, “ক্ষমতায় আসার পরে আমরা হাতে যেটুকু সময় পেয়েছি, সেই তুলনায় শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে এ বছর অনেক ভাল কাজ হয়েছে। পরের বছর শব্দবাজি বন্ধে ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তা দিচ্ছি।” বৃহস্পতিবার রাতেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ৪৫টি দল গোটা শহরে ঘুরে নজরদারি চালিয়েছে বলে পরিবেশমন্ত্রী জানিয়েছেন। তা ছাড়া, অভিযোগ নেওয়ার জন্য সারা রাত খোলা ছিল পর্ষদের কন্ট্রোল রুম। রাতভর টহল দিয়েছেন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সদস্যেরাও।
নববাবু জানান, বুধবার রাতে দক্ষিণ কলকাতায় বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে প্রচুর বাজি ফেটেছে। তিনি বলেন, “হাসপাতাল এলাকাগুলি বাজিমুক্ত করার জন্য বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।”
শহর ও শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় তাই বাজি ফেটেছে দেদার। মন্ত্রীর বিশেষ তৎপরতা সত্ত্বেও বহুতল আবাসনের ভিতরে বা ছাদে শব্দবাজি ফাটানো বন্ধ করা যায়নি। পুলিশের বক্তব্য: তারা বহুতলের ছাদে উঠতে না উঠতেই অনেকে ছাদ থেকে নেমে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গিয়েছেন। তবে, এই ‘চোর-পুলিশ খেলা’ সত্ত্বেও বাগুইআটি থানার পুলিশ জানায়, কালীপুজোর রাতে তারা নিষিদ্ধ শব্দবাজি বিক্রির অভিযোগে ২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। আটক হয়েছে ৬০ কেজি নিষিদ্ধ বাজি। লেকটাউন থানার পুলিশ ৪১ জনকে গ্রেফতার করে। আটক ৭০ কেজি শব্দবাজি।
হাওড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে গভীর রাত পর্যন্ত রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড এবং পুলিশের পদস্থ অফিসারদের টহলদারি সত্ত্বেও থামানো যায়নি শব্দবাজির দৌরাত্ম্য। শিবপুর থেকে বালি, মধ্য হাওড়া থেকে পশ্চিম হাওড়া সর্বত্র অবাধে ফেটেছে শব্দবাজি। বিশেষত, জিটি রোডের ধারে যে সব বহুতল রয়েছে, সেগুলিতে বারবার হানা দিয়েও পুলিশ শব্দবাজি ফাটানো বন্ধ করতে পারেনি। তবে, নিষিদ্ধ বাজি ফাটানো-সহ প্রকাশ্যে নেশা করা, জুয়া খেলা ইত্যাদির অভিযোগে মোট ১৮৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে ১০৫ কেজি। ব্যারাকপুর এলাকাতেও দেদার শব্দবাজি ফেটেছে বলে অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে ব্যারাকপুরের এসডিপিও অমিতকুমার সিংহ বলেন, “শব্দবাজি ফেটেছে বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন অভিযোগ করেছেন।” |