জমি বিক্রি ও কারখানার পুনর্গঠন নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বার বার। কিন্তু তার জবাবে হিন্দুস্থান মোটরস কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি রাজ্য সরকার।
এই অবস্থায় হিন্দুস্থান মোটরসের জমি সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগের তদন্তভার ভিজিল্যান্স কমিশনের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। মহাকরণ-সূত্রের খবর: সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ভিজিল্যান্স কমিশন তদন্ত-প্রক্রিয়া শুরুও করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট জমি বিক্রি সংক্রান্ত যত ফাইল ভূমি দফতরের কাছে আছে, সব চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
হুগলি জেলায় দেশের প্রাচীনতম এই গাড়ি কারখানাটি গড়ে উঠেছিল ১৯৪৮ সালে। প্রায় ৪২৭ একর জমির উপরে কারখানা তৈরি হলেও অতিরিক্ত ৩১৪ একর সংস্থার হাতে থাকে। গাড়ির বাজারে প্রতিযোগিতায় প্রায় অর্ধ শতক টিকে থাকার পরে, ২০০০-এর গোড়ার
দিকে হিন্দ মোটরসের ব্যবসায় সঙ্কট দেখা দেয়। তখন অতিরিক্ত জমি বেচে কারখানা বাঁচাতে উদ্যোগী হয় হিন্দুস্থান মোটরস।
কিন্তু যে জমি সরকার দিয়েছিল কারখানা তৈরির জন্য, তা সরকারের অনুমতি ছাড়া অন্য কাজে লাগানো যায় না। সেই অনুমতি চেয়ে পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য (ডিটেলড প্রজেক্ট রিপোর্ট, সংক্ষেপে ডিপিআর) রাজ্য ভূমি দফতরে জমা দেয় ওই গাড়ি সংস্থা। ২০০৫-এ পেশ করা সেই ডিপিআরে বলা হয়েছিল, উপনগরী গড়ত্যে ৩১৪ একর জমি বিক্রি করে যে ৮৫ কোটি টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে কারখানার পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি শ্রমিকদের বকেয়াও মিটিয়ে দেওয়া হবে।
তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার দফতর প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। তদানীন্তন রাজ্য মন্ত্রিসভাও সম্মতি দেয়। জমি হস্তান্তরের ‘ফি’ বাবদ রাজ্যের ঘরে আসে ১০ কোটি টাকা।
পরবর্তীকালে সরকার জানতে পারে, ওই ৩১৪ একর বেচে কারখানা-কর্তৃপক্ষ আসলে পেয়েছে ২৮৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ ডিপিআরে উল্লিখিত পরিমাণের দু’শো কোটি বেশি। অথচ সেটা সরকারকে জানানো হয়নি। উপরন্তু প্রাপ্ত অর্থের আয়-ব্যয়ের কোনও হিসেব সরকারের কাছে দাখিল করেনি হিন্দুস্থান মোটরস। এই নিয়ে বাম আমলে দু’-দু’টো তদন্ত কমিটি গড়া হয়। তাদেরও রিপোর্ট যায় কারখানা-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই।
কিন্তু তার পরেও হিন্দ মোটরসের জমি ঘিরে ঘনীভূত হচ্ছে সন্দেহের জাল। কী রকম?
প্রাথমিক ভাবে ভিজিল্যান্স কমিশন দেখেছে, কারখানা-কর্তৃপক্ষ জমির মূল্যায়ন করিয়েছিল এক বেসরকারি ব্যাঙ্ককে দিয়ে। এ ব্যাপারে তারা জেলা কালেক্টরেটের সঙ্গে কোনও পরামর্শ করেনি। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের দেওয়া জমি বিক্রির আগে যেখানে সরকারি অনুমতি আবশ্যিক, সেখানে রাজ্য প্রশাসনকে এড়িয়ে বেসরকারি ব্যাঙ্ককে দিয়ে জমির মূল্যায়ন আদৌ করানো যায় কি না। পাশাপাশি ওই সময়ে ভূমিসংস্কার দফতরের ভূমিকা কী ছিল কিংবা বিগত সরকার সব দিক বিবেচনা করে হিন্দ মোটরসকে জমি বিক্রির অনুমতি দিয়েছিল কি না এ সবও ভিজিল্যান্সকে তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে আগের সরকারের শিল্প পুনর্গঠন দফতরের ভূমিকাও। কেন?
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “কারখানার বাড়তি জমি বিক্রির আগে শিল্প পুনর্গঠন দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, গোটা বিষয়টির উপরে নজরদারির জন্য তারা একটা ‘মনিটরিং কমিটি’ গড়বে। কিন্তু তিন বছর পরে, ২০০৯ সালে শিল্প দফতর চিঠি দিয়ে ভূমি দফতরকে জানায়, লোকাভাবের কারণে তারা সেই কমিটি তৈরি করতে পারেনি।” তত দিনে অবশ্য কারখানা-কর্তৃপক্ষ সমস্ত অতিরিক্ত জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভিজিল্যান্স-কর্তাদের বক্তব্য: নিছক কর্মীর অভাবে মনিটরিং কমিটি তৈরি করা যায়নি, না কি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে, তা যাচাই করা হচ্ছে।
এবং মনিটরিং কমিটি যে তৈরি করা যাচ্ছে না, সেই খবরটুকু জানাতে কেন তিন-তিনটে বছর গড়িয়ে গেল, সে প্রশ্নও এখন মাথা চাড়া দিয়েছে। যার উত্তর খুঁজতে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের কমিশনে ডেকে পাঠানো হতে পারে বলে মহাকরণ-সূত্রের খবর। |