|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
সশব্দ |
কালীপূজা সম্পন্ন হইল। সশব্দেই। বিধিনিষেধের ঢক্কানিনাদকে ছাপাইয়া উঠিল শব্দবাজির প্রতাপ। শব্দাসুর ঠিক কী পরিমাণ অত্যাচার করিয়াছে, তাহা লইয়া মতভেদ বিস্তর। সরকারি ভাষ্য, অল্পই হইয়াছে। নাগরিকগণ দ্বিমত। রাজ্য জুড়িয়া দীপাবলির রাত্রের অভিজ্ঞতা জানাইতেছে, কেন দ্বিমত। শব্দবিধি সামান্যই কার্যকর হইয়াছে, এবং তাহাও কেবলমাত্র কলিকাতা মহানগরীর ভিতর। রাজ্যের অন্যত্র দেদার শব্দবাজি ফাটিয়াছে। কলিকাতায় দিনের বেলা এবং সায়ংকালে শব্দের মাত্রা তুলনায় অল্পাধিক সহনসীমার নাগালেই ছিল। অতঃপর, রাত্রি বাড়িয়াছে। বাজির আওয়াজও বাড়িয়াছে। বিধাননগরের জনৈক নাগরিক জানাইয়াছেন, মনে হইতেছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। কথাটি একাধিক অর্থে সত্য। উপর্যুপরি শব্দবাজির তাণ্ডব কর্ণে তালা লাগাইবার দশা করিয়াছে। যেমন, যুদ্ধক্ষেত্রে হয়। অথচ, অন্য একটি অর্থে এই কালীপূজা অন্য একটি রণভূমি হইবার কথা ছিল। শব্দাসুরের সহিত প্রশাসনিক তৎপরতার যুদ্ধ। শব্দাসুরের সহিত নাগরিক সচেতনকার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধটি সুসম্পন্ন হইল না। শব্দের অত্যাচার অনেক এলাকাতেই নাগরিকদের অতিষ্ঠ করিল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বাহির হইয়াছিলেন স্বয়ং রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী মহোদয়। তাঁহার কর্ণকুহরে অবশ্য বাজির দাপট তেমন আসে নাই। তিনি, এমনকী, পথে নামিয়া দূরাগত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধুরীও শুনিয়াছেন। রাজ্য জুড়িয়া তো বটেই, খাস কলিকাতাতেও তাঁহার সহ-নাগরিকদের অভিজ্ঞতা প্রায়শই তেমন মাধুর্যময় নহে। কারণ, শব্দবাজি শুধু ফাটে নাই, কার্যত অবাধে ফাটিয়াছে।
মাননীয় মন্ত্রিবর বলিয়াছেন, এই পরিমাণ শব্দবাজি লক্ষ্মীপূজার সময়েও ফাটিয়া থাকে। মন্তব্যটি অবাঞ্ছিত। কারণ, ইহার ভিতরে শব্দবাজির তাণ্ডবের প্রতি এক ধরনের স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ের সুর স্পষ্ট। যেন জগৎপারাবারের তীরে শিশুরা খেলা করিতেছে, একটু বকিয়া দিলেই হয়, আবার না-দিলেও চলে, মৃদু হাস্য লইয়া সেই ক্রীড়ামোদটি উপভোগ করিলেও খারাপ হয় না। শব্দবাজির ক্ষেত্রে যে এই জাতীয় মনোভাবে কাজ হইবে না, তাহা ইতিপূর্বে একাধিক বার দেখা গিয়াছে। পরিভাষায় যাহাকে ‘জিরো টলারেন্স’ বলে, তেমন একটি কঠোর মনোভাব ছাড়া কিছুই হইবার নহে। ‘আহা, একটিই তো ফাটিয়াছে’ বলিয়া করুণা প্রদর্শন করিলে শব্দবিধিটিই কবরস্থ হইবে মাত্র, অন্য কোনও লাভই হইবে না। দুঃখের বিষয়, প্রশাসন সেই মনোভাবটি দেখাইতে ব্যর্থ হইয়াছে। নাগরিকগণ অতিষ্ঠ হইয়া থানায় ফোন করিয়াছেন। বিধিসম্মত আশ্বাসবাণী মিলিয়াছে, কাজ হয় নাই। শব্দবিধির প্রতি এক ধরনের নীরব উপেক্ষা এবং শব্দবাজির প্রতি এক ধরনের নীরব প্রশ্রয় প্রদর্শন করিলে যাহা ঘটিবার কথা, তাহাই ঘটিয়াছে।
কালীপূজা শেষ, কিন্তু বাজির মরসুম অ-সমাপ্ত। প্রশাসনিক তৎপরতা প্রদর্শনের সময় এখনও ফুরায় নাই। ইচ্ছা করিলে প্রশাসন এখনও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে। করিবে কি না, তাহাই প্রশ্ন। পাশাপাশি, ইহাও সত্য যে, নাগরিকগণের একটি বড় অংশ শব্দ-সংক্রান্ত সচেতনতার ধারপাশ দিয়া হাঁটেন নাই। ইহা খেদজনক। আমার উল্লাসকে বাজির বিকট আওয়াজের মাধ্যমে দিকে দিগন্তরে ছড়াইয়া দিতে নাই সেই জরুরি বোধটিই কাজ করে নাই। যে রাজ্যের নাগরিক প্রবল বিক্রমে শব্দবাজি ফাটাইয়া এই ধরনের মত্ত অচৈতন্যের প্রমাণ রাখেন, তাঁহাদেরও চৈতন্যোদয় জরুরি। অন্যথায়, শব্দের পরাক্রম বাড়িতেই থাকিবে। প্রশাসন ব্যবস্থা নিক। নাগরিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হউক। কিছু বিপথগামী বিধিভঙ্গকারীর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হউক। পরিস্থিতি আয়ত্তে আসিবার সম্ভাবনা প্রবল। প্রয়োজন সদিচ্ছার। |
|
|
 |
|
|