|
|
|
|
প্রবন্ধ...
আজ নিবেদিতার ১৪৫তম জন্মজয়ন্তী |
ভগিনী নিবেদিতার মনোময়ী মা কালী |
স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ |
জন্মসূত্রে বিদেশিনি হয়েও ভগিনী নিবেদিতা তাঁর পরবর্তী জীবনে হয়ে উঠেছিলেন একান্তভাবেই ভারতীয়। নিজের সমগ্র জীবনকেই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন এ দেশের নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে। ভারতকে তিনি কতটা আপন করে নিয়েছিলেন তার অন্যতম প্রমাণ তাঁর কালীপ্রেম। তেজস্বিনী এই সন্ন্যাসিনী মা কালীকে মেনেছিলেন ভীষণ ভাবেই। কিন্তু তা আমাদের প্রচলিত শাস্ত্র বা মন্ত্রতন্ত্রের পথ ধরে নয়। নিবেদিতার মা কালী একান্তই তাঁর নিজস্ব।
মা কালী সম্বন্ধে নিবেদিতার নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা কেমন ছিল তার পরিচয় মিলবে তাঁর লেখা অসংখ্য চিঠিপত্র ও বক্তৃতার মধ্যে। ‘কালী অ্যান্ড হার ওয়রশিপ’, ‘কালী ওয়রশিপ’, ‘কালী দ্য মাদার’ এমন লেখাগুলিতে নিবেদিতার অনুপম ভাষা-শৈলীতে যেন প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেন তাঁর মনোময়ী মা।
ফরাসি লেখিকা নিজেল রেঁম লিখিত ‘নিবেদিতা’ গ্রন্থের সূত্রে জানা যায়, নিবেদিতা মা কালী সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা-কল্পনার কথা একবার লিখে জানিয়েছিলেন প্রিয় বান্ধবী মিস ম্যাকলাউডকে। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘কালী সম্বন্ধে একটা নতুন করে ভাব মনে জেগেছে। মায়ের পদতলে শায়িত শিবের ঢুলুঢুলু চোখ দুটি মায়ের দৃষ্টির সঙ্গে মিলেছে কী করে, তাই দেখছিলাম। কালী ওই সদাশিবের দৃষ্টির সৃষ্টি। নিজেকে আড়াল করে সাক্ষীরূপে তিনি দেখছেন দেবাত্মশক্তিকে। শিবই কালী, কালীই শিব। মানুষের মনে বিপুল শক্তির আলোড়ন চলছে। তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে এই রূপে এই কী সত্য! অর্থাৎ মানুষই কি দেবতাকে সৃষ্টি করে। তাই ভাবি। বিশ্বের রহস্য কোন লাস্যময়ীর লীলাচাতুরী হালকা ওড়নায় ঢাকা।” (অনুবাদ-নারায়ণী দেবী)।
লক্ষণীয় এখানে, নিবেদিতার অভিনব ভাব-ব্যঞ্জনায় ব্রহ্মের মায়াশক্তি (যা ‘কালী-ব্রহ্মের’ অভেদতত্ত্বেই রূপান্তরিত) তথা এই সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্য ‘কোন লাস্যময়ীর লীলাচাতুরির হালকা ওড়নায় ঢাকা’ বলে অভিহিত।
নিবেদিতা তাঁর সাধনার জগতে কোন উচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর মা কালী-বিষয়ক রচনাগুলি পাঠ করলেই। নিবেদিতার কালী-বিষয়ক ধ্যানধারণা শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-আলোকেই আলোকিত, কিন্তু তাঁর নিজস্ব মানসপূজায় নিবেদিতা যে কুসুমগুলি চয়ন করেছিলেন, তার অন্তর সৌরভ আবিষ্ট করে রাখে ভক্ত পাঠককে। আমরা জানি, স্বামী বিবেকানন্দ মনেপ্রাণে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হয়েও কী ভাবে সাকারবাদীদের মা কালীর চরণে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কারণে। সেই বিবেকানন্দেরই মানসকন্যা নিবেদিতা অতি বড় যুক্তিবাদী হয়েও মা কালীর মাধুর্যে আত্মহারা হয়েছিলেন যদিও সহজাত যুক্তিনিষ্ঠায় তাঁর মা কালীকে নিবেদিতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন হৃদয়মন্দিরে।
এই সূত্রেই মনে পড়ে যায়, খোদ কলকাতা শহরে নিবেদিতাকে ঘিরে অভিনব এক ঘটনার কথা। তা হল, ১৮৯৯ সালে কালীতীর্থ কালীঘাট মন্দিরে মা-কালী সম্বন্ধে নিবেদিতার বক্তৃতা। এর আয়োজক ছিলেন কালীঘাট মন্দিরের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। দিনটি ছিল ২৮ মে, ১৮৯৯। ইউরোপাগত এক নারী কালীঘাটের মতো পবিত্র ক্ষেত্রে বসে মা কালী সম্পর্কে বলবেন, এ কথা জানাজানি হওয়ার পর যেন বিস্ফোরণ হল কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে। (তখনকার দৃষ্টিতে নিবেদিতা ম্লেচ্ছ তথা অচ্ছুত)। এ নিয়ে প্রবল জল ঘোলা হয়েছিল সে সময়। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন ওই অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তেজস্বিনী নিবেদিতাকে ঠেকানো যায়নি। নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন নিবেদিতা।
অবশ্য এর আগে কলকাতার ‘অ্যালবার্ট হল’-এ নিবেদিতা কালী সম্বন্ধে আর একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯)। কিন্তু কালীঘাটে নিবেদিতার বক্তৃতার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানতেই হবে, মন্দির-কর্তৃপক্ষ নিবেদিতার ব্যাপারে খুবই উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁরা স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দকেই নিবেদিতার বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। স্বামীজি রাজি হননি বিশেষ কারণে। যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে কালীঘাট মন্দির প্রাঙ্গণে প্রায় তিন হাজার লোক সমবেত হয়েছিলেন নিবেদিতার বক্তৃতা শুনতে। তখনকার দিনের কলকাতার দেশি-বিদেশি সব নামী পত্রিকায় বক্তা ও বক্তৃতার বিষয়ে নিয়ে যথেষ্ট প্রশস্তিও হয়েছিল। নিবেদিতার বক্তৃতা এতই হৃদয়গ্রাহী হয় যে, মন্দির-কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে নিবেদিতার সেই বক্তৃতার কয়েক হাজার কপি মুদ্রিত করে বিনামূল্যে বিতরণ করেছিলেন। পুস্তিকাটির একটি কপি আজও বেলুড় মঠের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
কালী সম্বন্ধে ভগিনী নিবেদিতার ধ্যান-ধারণা নিঃসন্দেহে তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্ত। বিবেকানন্দের মা কালী রুদ্রতেজের প্রতীকভয়ঙ্করী মৃত্যুরূপা। নিবেদিতার মা কালীও তাই দীনা-হীনা নন। নিবেদিতার চোখে ‘তিনি ভয়াল, ভয়ঙ্করী। তিনি উলঙ্গিনী। স্বামী-বক্ষে নৃত্যপরা। কণ্ঠে নৃমুণ্ডমালা। সদ্য নিহতদের তপ্ত রক্তপানে ব্যাদিত রসনা। খড়্গধারিণী। নিক্ষিপ্ত অস্ত্রমধ্যে এবং ভূতপ্রেত পিশাচদলের মধ্যে বিরাজমানা। সর্বনাশা মেঘপুঞ্জের মতোই তিনি কৃষ্ণবর্ণা। মুক্ত কেশ ছড়িয়ে আছে পদতলে। হা-হা হাসিতে লজ্জা পায় ব্রজধ্বনি। তিনি স্বয়ং ত্রাস!’
এমন ভয়ঙ্করী মাতৃমূর্তিকেই নিবেদিতা তাঁর ধ্যানাসনে বসিয়ে রাখেন আর কালী-সম্বন্ধে তাঁর মনে নিত্যনতুন ভাব জেগে ওঠে। কালীঘাট-বক্তৃতা প্রসঙ্গেই এক বান্ধবীকে তিনি লেখেন ‘‘কালী বিষয়ে আমার নতুন অনুভূতি জেগেছে। ...শায়িত ঈশ্বরের (শিবের) আবেগগ্রস্ত দৃষ্টির অনুসরণ করে দেখলাম, তা সত্যই দেবীর (কালীর) নয়নের সঙ্গে মিলিতযে কথা সদানন্দ আমাকে বলেছিলেন। তার পর দেখলাম, কালী কী ভাবে ‘মা’ সম্বন্ধে স্বামীজির দর্শনের অনুরূপ। শুধু শিবের পক্ষেই ঈশ্বর- সত্যকে ওই আকারে দেখার সাহস করা সম্ভব শুধু শিবই পদদলিত হয়েও ওই প্রেমাবিষ্ট নয়নে দেখতে সমর্থ। বুঝতে পারছ, সমস্ত ব্যাপারটা কত স্পষ্ট!’’
অতএব ‘মাভৈঃ’! ভয়ঙ্করী কালী মানুষেরই ভয়ঙ্কর বাসনা-সৃষ্টি! বাসনামুক্ত মানবের কাছে এই মা নিত্যানন্দময়ী! বাসনার কালি সব ধুয়ে মুছে গেলেই মায়ের নামে সব জ্বালা জুড়ায়, হৃদয়ক্ষতে স্নিগ্ধ প্রলেপ পড়ে। তাই নিবেদিতার কাছে বাসনার মিথ্যাত্ব প্রমাণিত হলে কালীর ভয়ঙ্করী রূপটিও অন্তর্হিত হয়।
নিবেদিতা বলেন ‘মায়া মিথ্যা, কালী তারই প্রতীক। কালীকে যদি আদর্শ হিন্দু নারী করে চিত্রিত করা হত, তা হলে তিনি সত্য হয়ে উঠতেন। তাঁর অবাস্তবতা দৃশ্যমান করবার জন্য কালী নিজেই তাই করেছেন তাঁকে আদর্শ না-নারী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। শিবকে পদতলে তিনি আবৃত করে আছেন, নাচছেন শিবের বুকে, অন্যের মনোযোগ টেনে এনেছেন নিজের ওপরে যেমন মরীচিকা ঝলমল করে উঠে বিভ্রান্ত করে দৃষ্টিকে। ‘তাই কালীকে ভেদ করে দৃষ্টি প্রেরণ করতে হবে, তাঁকে অতিক্রম করে যেতে হবে। সে-ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা, তাঁর উপাসনা ছাড়া গত্যন্তর কী?
কোনও বই যদি কেউ মুখস্থ করতে চায়, সে কি সাদা কাগজের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে? ...তাই আসল সাধক, যিনি তাঁর ভিতর দেখে তাঁকে জেনেছেন, তিনি শান্ত ভাবে তাঁর অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন। যে ভাবে তিনি দেখান নিজেকে, সে ভাবে তাকে না দেখে দেখতে পেরেছেন আসল যা তিনি, তাঁকে। ব্রহ্মের মধ্যেই তাঁর সত্য অস্তিত্ব, যেমন জাগ্রত ‘আমি’ থেকেই স্বপ্নের ‘আমি’ উদ্ভূত। কোন নির্দিষ্টকালে স্বপ্ন যতই জীবন্ত সত্য বলে মনে হোক, জাগ্রত অবস্থায় তার অস্তিত্ব নেই। দ্রষ্টা বলেন, কালীকে যা মনে হয়, তা তিনি নন, যথার্থত কালী ও ব্রহ্ম এক। তিনি মোক্ষদায়িনী তারা, তিনি ব্রহ্মময়ী।’
গুরু বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে ভারতমাতার সেবায় উৎসর্গ করে বলেছিলেন ‘যদি আমার নিজের কোনও অভিপ্রায় সিদ্ধির জন্য তোমাকে বলি-রূপে গ্রহণ করিয়া থাকি, তবে এই বলি বৃথা হউক, আর যদি ইহার মূলে সেই পরমা শক্তির ইচ্ছা থাকে, তবে তুমি সার্থক হও, তোমার জয় হোক।’ গুরুর আশীর্বাদে, পরমা শক্তির ইচ্ছায় তা সার্থক হয়েছিল নিবেদিতার জীবনে। |
|
|
|
|
|