|
|
|
|
নারী-নিগ্রহেও দ্বিতীয় বাংলা, বলছে রিপোর্ট |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
মাওবাদী হিংসা রয়েছে। আছে বেআইনি অনুপ্রবেশের সমস্যাও। কিন্তু তার থেকেও বেশি আছে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ। ২০১০ সালের অপরাধমূলক ঘটনার রাজ্যওয়াড়ি খতিয়ান বলছে, মহিলাদের উপর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারই হোক বা নারী পাচার, নাবালিকা ধর্ষণ হোক বা দেহ-ব্যবসার জন্য মেয়ে বিক্রি, সব হিসেবেই অধিকাংশ রাজ্যকে পিছনে ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
সারা দেশে অপরাধের খতিয়ান নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র ২০১০-এর রিপোর্ট বলছে, সারা দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ১২.২% ঘটনাই ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। অন্ধ্রপ্রদেশের ঠিক পরেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান। দেশের জনসংখ্যার ৭.৬% মানুষের বাস যেখানে পশ্চিমবঙ্গে, সেখানে তুলনামূলক ভাবে এই হিসেবটা যথেষ্টই বেশি। গত বছর পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ২৬,১২৫টি মামলা পুলিশের খাতায় জমা পড়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হল স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অত্যাচারের ঘটনা। গত বছর সারা দেশে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮-এ ধারায় এই ধরনের অপরাধ ঘটেছে ৯৪,০৪১টি। এর মধ্যে ১৯% ঘটনাই ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। জেলাওয়াড়ি হিসেবেও দেশের সব জেলাগুলির থেকে এগিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ।
রাজ্যগুলির থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে আসা হিসেব অনুযায়ী, ধর্ষণের ক্ষেত্রেও গোটা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। মধ্যপ্রদেশের ঠিক পরেই। দেশে ২০০৯-এ যেখানে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ২১,৩৯৭টি, সেখানে ২০১০-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২,১৭২টিতে। এর মধ্যে ১০.৪ শতাংশ বা ২,৩১১টি ঘটনাই ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। নাবালিকাদের ভুল বুঝিয়ে যৌন সম্পর্ক তৈরি করার মামলার ক্ষেত্রেও সবথেকে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, মেয়ে পাচার বা ‘ইমপোর্টেশন অফ গার্লস’-এও উত্তর ২৪ পরগণা জেলাওয়াড়ি হিসেবে সবথেকে এগিয়ে রয়েছে। পিছিয়ে থাকছে না কলকাতাও। শহরে গত বছর এই ধরনের যে ৭টি অভিযোগ পুলিশের কাছে জমা পড়েছে, তার মধ্যে ৩টিই কলকাতায়। দেহ ব্যবসায় নামানোর জন্য গত বছর মেয়েদের বেচাকেনার ঘটনা ঘটেছিল ২০৮টি। এর মধ্যে ১৬৩টিই পশ্চিমবঙ্গে।
রাজ্য পুলিশ কর্তারা বলছেন, পুলিশের কাছে অভিযোগ বেশি জমা পড়েছে বলেই অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অপরাধ বেশি হয়েছে, এমনটা নয়। যেখানে অভিযোগ বেশি জমা পড়ে, সেখানে অপরাধের হিসেবও বেশি হয়। অনেক জায়গায় মহিলারা পুলিশের কাছে পৌঁছতেই পারেন না। অনেক রাজ্যে সেই সচেতনতাও নেই। কাজেই সেই দিকটিও ভাবতে হবে। রাজ্যের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বলেন, “পুলিশের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ ও সচেতনতা বেশি থাকার ফলে আমাদের রাজ্যে মহিলারা অনেক বেশি অভিযোগ জানাতে আসেন। তাই অপরাধের হিসেবটাও বেশি। তবে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ঠেকানোর জন্য আমরা সব দিকই খতিয়ে দেখছি।” নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ কিন্তু বলছেন, সচেতনতা বেশি বলেই পুলিশের খাতায় অভিযোগ বেশি, না কি সত্যিই অপরাধমূলক ঘটনা বেশি, এই বিতর্কটা থাকবে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন কতটা সক্রিয়, তা বুঝতে গেলে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার দেখতে হবে। কেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে, সে ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার রাজ্যে মাত্র ১৩.৫ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। শাশ্বতীর তাই যুক্তি, “উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির মতো মহিলাদের উপর হিংসাটা যেমন প্রকাশ্যে হয়, তেমনটা হয়তো এ রাজ্যে হয় না। কিন্তু হিংসাত্মক মনোভাবটা অন্তর্নিহিত থাকে, যেটা অপরাধমূলক ঘটনায় প্রকাশিত হয়ে পড়ে।” তাঁর যুক্তি, “পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের সমস্যা বা সমানাধিকারের বিষয়টা লঘু করে দেখার প্রবণতা আছে। বলা হয়, সব আইনই মেয়েদের পক্ষে। দীর্ঘ বাম-জমানায় সে সমস্যা দূর হয়নি। নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, তিনি শুধু মহিলাদের মুখ্যমন্ত্রী নন, সকলের মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ তাঁকে কেউ নারী মুখ্যমন্ত্রী বলে চিহ্নিত করুক, এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট রক্ষণশীল।”
অপরাধের খতিয়ান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ২০১০-এ যত খুনের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ৩০.৬% ঘটেছে রাজনৈতিক সংঘর্ষে। ২৭% খুন হয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, মাওবাদী সমস্যা ও বিধানসভা ভোটের আগে সংঘর্ষের ফলেই এমন হিসেব মিলেছে। বিদেশি আইনে অপরাধের সংখ্যা সারা দেশে কমলেও গত বছর ওই আইনে যে ১২০৪টি মামলা হয়েছে, তার পঞ্চাশ ভাগের বেশি মামলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সীমান্তবর্তী রাজ্য বলে বাংলাদেশি বেআইনি অনুপ্রবেশের সমস্যার ফলেই পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। |
|
|
|
|
|