|
|
|
|
ঘণ্টায় ১৫টি আত্মহত্যা দেশে |
এ বছরে দ্বিতীয় স্থানে আত্মঘাতী বাঙালি |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি বলেছিলেন, “সভ্যতাকে হনন করা যায় না। সভ্যতা আত্মঘাতী হয়।”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম আজ সেই কথাটাই ভাবছিলেন কি না, জানা যায় না। তবে তাঁর হাত দিয়েই প্রকাশ পেল ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান (২০১০)। সেখানে দেখা যাচ্ছে, এ দেশে প্রতি ঘণ্টায় ১৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং তার মধ্যে বিবাহিতরাই সংখ্যাগুরু (৬৯.২ শতাংশ)। এ ব্যাপারে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ অবশ্যই সামনের সারিতে আছে। ২০০৮ এবং ২০০৯-এ এ দেশে আত্মহত্যায় শীর্ষে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ২০১০-এ সে দ্বিতীয় স্থানে নেমেছে। তবে তার মানে এ নয় যে, গত বছরে বাঙালি কিছুটা কম আত্মহত্যা করেছিল। ২০০৮-১০ টানা ৩ বছর পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যার হার একই রয়েছে, ১১.৯ শতাংশ। শুধু ২০১০-এ পশ্চিমবঙ্গকে ডিঙিয়ে গিয়েছে তামিলনাড়ু, ১২.৩ শতাংশ।
আত্মহত্যায় পশ্চিমবঙ্গের ধারাবাহিক ‘সাফল্যে’র কারণ? মনোবিদ সত্যজিৎ আশ জানালেন, অন্য রাজ্যের তুলনায় কেন পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যা বেশি, তার ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। তিনি বলেন, “এটা নতুন নয়। কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যার হার বেশি।” ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোয় তথ্য নথিভুক্তির কিন্তু কোনও কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা নেই। রাজ্যগুলির কাছ থেকে তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়, তার ভিত্তিতেই রিপোর্ট তৈরি হয়। সুতরাং সত্যজিৎবাবুর মতে, “এমনও হতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গে ঘটনা নথিভুক্তির ব্যবস্থাটা অনেক শক্তপোক্ত। তাই সঠিক সংখ্যাটা কেন্দ্রের জমা পড়ছে। অন্যান্য রাজ্যে হয়তো বহু ঘটনা নথিভুক্তই হয় না। সেই কারণে হয়তো তারা পরিসংখ্যানে পিছনের দিকে রয়েছে।” |
|
কারণ যাই-ই হোক, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আত্মহননে পিছপা নয় বাঙালি। কিন্তু তাই বলে যদি ভেবে নেওয়া হয়, জীবনানন্দের কলকাতাই এ ব্যাপারে অগ্রণীর ভূমিকা নিচ্ছে, তা হলে কিন্তু ভুল হবে। কলকাতার মেট্রোযাত্রীদের অভিজ্ঞতা যাই বলুক না কেন, সামগ্রিক পরিসংখ্যানের বিচারে দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে কিন্তু কলকাতা শহরেই। দেশের ২৫টি বড় শহরের মধ্যে সবচেয়ে আত্মহত্যা ঘটে জবলপুরে (৪১.৫%)। শুধু মেগাসিটিগুলো নিয়ে হিসেব করলে এগিয়ে থাকবে, বেঙ্গালুরু। কলকাতার মুখে হাসি আর ধরে
না, আত্মহত্যার হার এখানে মাত্র
২.১ শতাংশ।
রাজ্য এগিয়ে, কলকাতা পিছিয়ে কেন? মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আত্মহত্যার পিছনে অনেকটা দায়ী। কোথাও কোনও আশার আলো নেই, এমন একটা পরিস্থিতিতে গভীর অবসাদ ক্রমশ গ্রাস করে মানুষকে। এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনই হয়েছে। আর দারিদ্র যেহেতু আত্মহত্যার একটা মূল
কারণ, তাই হয়তো শহরের তুলনায় গ্রামে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি।”
দারিদ্র কখন অসহনীয় মানসিক চাপ এবং অবসাদের (আত্মহত্যার চালিকাশক্তি হিসেবে এই দু’টোর উপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন মনোবিদেরা) জন্ম দেয়? পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, কর্মহীনদের চেয়ে স্বনিযুক্তদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কিন্তু অনেক বেশি। যথাক্রমে ৭.৫ শতাংশ এবং ৪১.১ শতাংশ। কেন? সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের অনুমান, ‘‘স্বনিযুক্ত মানুষের কাজের ধারায় ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশি। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, এই অবস্থায় মানসিক চাপ তৈরি হয়। অনেকটা ঋণের ফাঁদে কৃষকের আত্মহত্যার মতো।” একই রকম ভাবে দেখানো যায় এক দিকে নিরক্ষর (১৯.৮), অন্য দিকে মাঝারি শিক্ষাপ্রাপ্ত (২২.৭)। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার হার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে (২৬.৩)। প্রশান্তবাবুর কথায়, “যাদের মধ্যে শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজটাই বোনা হয়েছে, তার বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।” মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পাশফেল’ গল্পটি মনে পড়তে পারে, যেখানে ফেল করা ছাত্রটি আত্মঘাতী হয়নি। আত্মহত্যা করে পাশ করা ছেলেটি। আর একটি যুক্তি বলছে, নিরক্ষর মানুষেরা প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছেন। তাঁদের অনেক খবরই পুলিশের কাছে পৌঁছয় না। তাই আত্মহননকারীদের মধ্যে
নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা কম পাওয়া যায় বলে
মনোবিদদের অভিমত।
পরিসংখ্যান এটুকুই দেখিয়ে দিচ্ছে যে, অশিক্ষিতের চেয়ে স্বল্পশিক্ষিতের মধ্যে আত্মহত্যা বেশি। রোজগারহীন মানুষের চেয়ে সদ্য রোজগার-হারানো বা রোজগারের অনিশ্চয়তায় ভোগা মানুষের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি। ঠিক যেমন অবিবাহিত মানুষের চেয়ে বিবাহিত মানুষের আত্মহত্যার সংখ্যাও ঢের বেশি। এ দেশে প্রতি পাঁচটি আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে এক জন করে গৃহবধূ খুঁজে পাওয়া যাবে। আর সামগ্রিক ভাবে আত্মহননকারীর মধ্যে ৭০.৫ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ এবং ৬৭ শতাংশ বিবাহিত মহিলা। জ্যোতির্ময়বাবু মনে করেন, “নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিয়ে অনেকের কাছেই একটা ‘স্ট্রেস’ বা চাপ। তার জেরে নিজেকে শেষ করে দিতে চান অনেকেই। দুটি পরিবার যেহেতু জড়িত, এক পক্ষের কেউ আত্মহত্যা করলে তারা অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশে দ্বারস্থ হয়। সেই সুবাদে ঘটনার নথিভুক্তিও বেশি ঘটে।”
আত্মহত্যার ‘নথিভুক্ত’ কারণের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ (৪৮ শতাংশ)। এর পরে আসবে পারিবারিক সমস্যা ও অসুস্থতা একত্রে (৪৪.৭ শতাংশ), প্রিয়জনের মৃত্যুশোক (২৮.৯ শতাংশ), শুধু পারিবারিক সমস্যা (২৩.৭ শতাংশ) এবং শুধু অসুস্থতা (২১ শতাংশ)। চিদম্বরম নিজে রিপোর্টটি প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘পুরুষের ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণই প্রধান। মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যক্তিগত এবং হৃদয়ঘটিত সমস্যাই আত্মহত্যার জন্য মূলত দায়ী।” প্রশান্তবাবু মনে করিয়ে দিলেন, “এ হল পিতৃতন্ত্রের উল্টো পিঠ। সেখানে পুরুষকে ছোট থেকেই শেখানো হয়, পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার। না পারলে সেটা তার পৌরুষের পরাজয়। স্বাভাবিক ভাবেই অর্থনৈতিক চাপ পুরুষকে অনেক বেশি বিদ্ধ করে।” তাপিত-পীড়িত হৃদয় মূলত কী করে তখন? তারও ‘পরিসংখ্যান’ আছে। ৩৩.১ শতাংশ মানুষ বিষ খান, ৩১.৪ শতাংশ ঝুলে পড়েন, ৮.৮ শতাংশ গায়ে আগুন দেন, ৬.২ শতাংশ ডুবে মরেন। তার পর সকলের জন্য লাশকাটা ঘর তো আছেই! |
|
|
|
|
|