প্রায় তিন দশক আগের কথা।
পুরোহিতের ছেলে পুজো মণ্ডপের সামনে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি বিড়বিড় করতে থাকে, “সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, আমার মুখ রোদে পুড়ে যায়। সর্বাঙ্গ জ্বলে।”
কালনার মেদগাছি গ্রামের সিংহরায় পরিবারের সদস্যরা ছোট্ট একটি ছেলের মুখে এই কথা শুনে সকলে তা দেবীর কথা বলেই মেনেছিলেন। তার পর থেকেই পুজো মণ্ডপে তাঁরা লাগিয়েছিলেন লাল পর্দা। সূর্য পশ্চিমে ঢললেই লাগানো হয় সেই পর্দা। দেবীর গরমে যাতে কষ্ট না হয়, তা জন্য লাগানো হয় ফ্যানও।
সিংহরায় পরিবারের সদস্য নিত্যানন্দ রায় ১২৪৪ বঙ্গাব্দে এই পুজো শুরু করেন। এ বার এই পুজো এ বার ১৭৫ বছরে পা দিল। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, পেশায় চাষি নিত্যানন্দবাবু খেলার ছলেই মাটির দেবীর মূর্তি গড়েন। তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে শুরু হয় পুজো। পুজো শুরু করার পর থেকেই পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। অনেক ভূ-সম্পত্তি লাভ করে সিংহরায় পরিবার। খগেন্দ্রগোপাল সিংহরায়ের সময় থেকে পুজোর জৌলুস বাড়ে। জনশ্রুতি, ওই গ্রামে আরও একটি সিংহরায় পরিবার রয়েছে। খগেন্দ্রবাবুর সময়ে পুজো নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে রেষারেষি চলত। |
সবচেয়ে লম্বা ‘গাছ বাজি’ তৈরি করতে খগেন্দ্রবাবু না কি নিজের ১৫ বিঘা জমিতে বাঁশ বাগান করেছিলেন। আর পরবর্তিকালে পরিবারের সদস্যরা যাতে ভালভাবে পুজো করতে পারেন তার জন্য তিনি রেখে যান বেশ কিছু দেবত্ব সম্পত্তিও।
পরিবারের সদস্যেরা জানান, ১৯৯৪ সাল থেকে দেবীর জন্য কংক্রিটের মন্দির তৈরি হয়। এক সদস্য চঞ্চল সিংহরায় বলেন, “তত দিন পরিবারের অনেকের বাড়িতেই টিনের চাল ছিল।” সিংহরায় পরিবারের পুজোয় প্রাচীন রেওয়াজ হল অন্নকৃষ্ট উৎসব। পুজোর দ্বিতীয় দিন এই উৎসব হয়। শুধু নিজেদের গ্রামই নয়, বেলেডাঙা, মানিকহার, শাঁখাটি-সহ বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারাও নিমন্ত্রিত হন। এই উৎসবের জন্য মন্দিরের পিছনের দিকে রয়েছে তিনটি চৌবাচ্চা। যেগুলি ভর্তি হওয়ার পরে শুরু হয় খাওয়া-দাওয়া। চঞ্চলবাবুর দাবি, “এই উৎসবে আদিবাসী থেকে মুসলিম সকলেই সমান ভাবে সামিল হন।” সিংহরায় পরিবারের পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। বলি দেওয়া হয় আখ ও ছাঁচি কুমড়ো। এ বার পুজোর ১৭৫তম বর্ষ হওয়ায় জৌলুস আরও বেশি। পুজো উপলক্ষে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঢোল-সানাই। বিজয়ার দিন হল রায়বেঁশে।
পারিবারিক পুজোর একটি রেওয়াজ অবশ্য ভেঙেছে। আগে অতিথিদের খাওয়ানো হত ২৩ মাছের টক। পরিবারের সদস্য শ্যামাপ্রসাদ সিংহরায় বলেন, “নিজেদের পুকুরে ভাল মাছ মেলে না। ২০০০ সালের পর থেকেই বাজারেও ৪-৫ কেজি ওজনের কাতলা মেলে না। বাধ্য হয়ে মাছের টক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
মেদগাছি গ্রামে দুর্গাপুজো হয় না। বাসিন্দারা আনন্দে মেতে ওঠেন বড়কালী পুজো ঘিরেই। এ লাকার বাসিন্দা নাসিরুদ্দিন মল্লিক বলেন, “বড়কালী পুজোয় সকলের নিমন্ত্রণ থাকে। মনে হয় না যে এটা কোনও বাড়ির পুজো।” |