বিজনবাড়ির পুনরাবৃত্তি এড়াতে রাজ্যের সব ক’টি সেতুর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বিকেলে দার্জিলিং থেকে ফিরে মহাকরণে ঢোকেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘরে পৌঁছেই তিনি পূর্ত দফতরের সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনকে ডেকে পাঠান। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, “পাহাড়ে বহু পুরনো সেতুগুলি কী অবস্থায় আছে তা খতিয়ে দেখে সবিস্তার রিপোর্ট দিন। প্রয়োজনীয় মেরামতিও করতে হবে। দেরি করা চলবে না।” রাজ্যের অন্য সেতুগুলি কী অবস্থায় রয়েছে, তারও সবিস্তার রিপোর্ট চান মুখ্যমন্ত্রী।
পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, পাহাড়ে বহু পুরনো ৩০টি সেতু রয়েছে। সবই ঝুলন্ত সেতু। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের ভাষায়, ‘সাসপেনশন ব্রিজ’। এই সেতুগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ। দীর্ঘদিন সেতুগুলির মেরামতি হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গেই এ দিন সন্ধ্যায় পূর্ত সচিব মহাকরণে বিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকেই দার্জিলিঙের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে চেয়ারম্যান করে একটি পর্যবেক্ষক দল গড়ে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন এবং পার্বত্য পরিষদের প্রতিনিধিদেরও ওই দলে রাখা হয়েছে। ওই দল আজ, মঙ্গলবার সকাল থেকে সেতুগুলির পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করবে বলে পূর্ত সচিব জানান। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়েই দার্জিলিঙের তিন মহকুমার এসডিও এবং বিভিন্ন ব্লকের বিডিওদের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পাহাড়ের কাঠের ঝুলন্ত সেতুগুলি নিয়ে রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে।’’ |
পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, পাহাড়ে কোনও পরিস্থিতিতেই কংক্রিটের সেতু করা যাবে না। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা জানান, পাহাড়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘সাসপেনশন ব্রিজই’ করতে হবে। পূর্তসচিব বলেন, “পার্বত্য পরিষদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পাহাড়ের সেতুগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে। মেরামতির প্রয়োজন থাকলে দ্রুত তা করেও দেওয়া হবে।” সেই খরচ পূর্ত দফতর থেকেই করা হবে বলে তিনি জানান। পাহাড়ের ওই সেতুগুলিতে কত ওজনের মালপত্র নিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারবে, সেই সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জানিয়ে কোনও সাইনবোডর্র্ লাগানো নেই। সেটা লাগানোর ব্যবস্থাও করা হবে। ওই নির্দেশ কোনও মতেই ভঙ্গ করা চলবে না।
রাজ্যের পূর্ত দফতরের হাতে সেতু পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি আধুনিক যন্ত্র রয়েছে। ওই ‘ব্রিজ ইন্সপেকশন ইউনিট’-এর একটি যন্ত্রে ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। ওই ক্যামেরা যে কোনও সেতুর তলায় ঢুকিয়ে ছবি তোলা যায়। তাতে সেতুর উপরের অংশই নয়, সেতুর তলায় ক্ষত রয়েছে কি না, তাও স্পষ্ট জানা যায়। সেই মতো মেরামতির কাজেও হাত দেওয়া হয়। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা জানান, ওই যন্ত্রটি এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গে রয়েছে। ওই ইউনিটের সাহায্যেই সেখানকার সেতুগুলির অবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে, সরু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় বিশাল আকারের ওই যন্ত্র তোলা যাবে না। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার এবং সেতু বিশেষজ্ঞদেরই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হবে বলে পূর্ত সচিব জানান। ওই যন্ত্রের মাধ্যমে এতদিন শুধু জাতীয় সড়কগুলির উপরের সেতুগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হত। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে এ বার থেকে ওই যন্ত্রের সাহায্যে রাজ্যের সব ক’টি সেতুর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার কাজও শুরু করে দেওয়া হচ্ছে বলে পূর্ত সচিব এ দিন মহাকরণে জানিয়েছেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় বিশেষত চা বাগানে যাতায়াতের সুবিধার জন্য বেশ কয়েকটি জায়গায় ঝুলন্ত কাঠের সেতু তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে লোলেগাঁও, গরুবাথান, সান্তালেখোলা, পেডং, রিমবিক, তোদে-তাংতা ও বালাবাসের কাঠের সেতুগুলি অন্তত ৫ দশকের পুরনো। সেগুলির সংস্কারও ঠিকমতো হয় না বলে অভিযোগ।
অগমচকের বাসিন্দা তথা পুলবাজার-বিজনবাড়ি শাখার মোর্চার সহ-সভাপতি সরণ শম্ভু অভিযোগ করেন, “বিজনবাড়ি থেকে রিমবিক যাওয়ার পথে একটি কাঠের ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। সেটিও প্রায় ৪০ বছর আগে সংস্কার হয়। নতুন করে সেটার সংস্কার করা না হলে আবার কোনওদিন বড় দুর্ঘটনা ঘটবে।” এ দিকে, সেতু দুর্ঘটনার জেরে পাহাড়ে যে এক মাস ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল তা আপাতত বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এ দিন দার্জিলিঙের ম্যাল চৌরাস্তায় মোর্চার তরফে বিজনবাড়ির ঝুলন্ত সেতুর ঘটনায় শোকসভা করা হয়। সেখানে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “এখন আনন্দের সময় নয়। তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা সব বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। দেওয়ালিতেও পাহাড়ের বাসিন্দাদের কম আতসবাজি পোড়ানোর জন্য অনুরোধ করছি।” |