ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে নেতা নিয়েই সঙ্কট সিপিএমে
ভোট-বিপর্যয়ের পাঁচ মাস পরেও পশ্চিমবঙ্গে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন না সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসু-নিরুপম সেনের মতো নেতারা মনে করছেন, সিপিএমের আবার উঠে দাঁড়াতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর লাগবে। কিন্তু সেই কাজ কার হাত ধরে শুরু হবে, তা নিয়েই তীব্র সঙ্কটে সিপিএম।
প্রশ্ন রয়েছে পদ্ধতি নিয়েও। সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এখনও তুঙ্গে। এই অবস্থায় তাঁকে তীব্র ব্যক্তিগত আক্রমণ করলে দলের কর্মীরা উত্তেজিত হবেন ঠিকই, কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ সেটি ভাল ভাবে গ্রহণ করবে না। এই কারণে গৌতম দেবের আক্রমণাত্মক অবস্থান আর সূর্যকান্ত মিশ্রের সহযোগিতামূলক বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা এই দুই রণকৌশল নিয়েও দলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
তবে সিপিএমের সব থেকে বড় সমস্যা যেটা, সেটা হল নেতৃত্বের সঙ্কট। দল বুঝতে পারছে, মমতা-উন্মাদনার অবসান ঘটিয়ে এই সরকারের বা প্রশাসন সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন তোলার জন্য সব থেকে বেশি দরকার বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু কে হবেন সিপিএমের পরবর্তী মুখ? সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। সিপিএমের রাজ্য নেতারা স্বীকার করছেন, এ বার পঞ্চায়েত ভোটে বহু জেলায় দলের পক্ষে প্রার্থী দেওয়াই সম্ভব হবে না। এহেন পরিস্থিতিতে সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও দলে ক্ষোভ রয়েছে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতা বলেন, “মানুষ যে এ বার আমাদের ভোট দেয়নি, তার আসল কারণটা হল প্রশাসনিক ব্যর্থতা। আমরা সেই ব্যথর্তাটাকে কী ভাবে দূর করব এবং কোন নেতাকে সামনে রেখে তা সম্ভব হবে, সেটা আমরা ঠিক করতে পারছি না। আর পলিটব্যুরো ব্যস্ত মতাদর্শগত দলিল নিয়ে।”
নেতৃত্ব কার হাতে?
নেতৃত্বের সঙ্কট বিজেপিতেও আছে। প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী কে হবেন, তা বিজেপি এখনও ঠিক করতে পারেনি। চলছে ক্ষমতার লড়াই। সিপিএমের তুলনায় বিজেপি অনেক বড় দল। তাদের নেতা অনেক। আছেন বেশ কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রীও। কিন্তু রাজ্যে সিপিএমের কাণ্ডারী হিসেবে মূলত পাঁচটি নাম ঘোরাফেরা করছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, সূর্যকান্ত মিশ্র, গৌতম দেব এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। বুদ্ধবাবু সম্পর্কে দলের একাংশের বক্তব্য, এত কিছুর পরেও তিনিই দলের মধ্যে সব থেকে বিশ্বাসযোগ্য এবং সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ‘ভদ্রলোক’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু দলের মধ্যে বুদ্ধ-বিরোধীদের বক্তব্য, গত লোকসভা নির্বাচনে যেমন আডবাণী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে জনাদেশ হারিয়েছেন এবং সেই যুক্তিতে বিজেপি-র একটা বড় অংশ তাঁকে আর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে রাজি নয়, সেই একই যুক্তিতে বুদ্ধবাবুও আর ভবিষ্যতে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে পারেন না। বুদ্ধবাবু নিজেও পলিটব্যুরো বৈঠকে আসাই কার্যত ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হচ্ছে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পলিটব্যুরো সদস্য হয়েছিলেন। সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারানোর পর আর পলিটব্যুরোতে থাকতে চাইছেন না।
বুদ্ধবাবু নিজেকে গুটিয়ে রাখায় দলের একটা অংশ সূর্যকান্তবাবুকে বিরোধী দলনেতা হিসেবে পলিটব্যুরোতে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এপ্রিল মাসের পার্টি কংগ্রেসে সূর্যবাবুকে পলিটব্যুরো সদস্য করার প্রস্তাব কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, প্রকাশ কারাট, নিরুপম সেন, বিমান বসুর মতো অনেক নেতাই বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যবাবুর ভূমিকায় খুশি। তাঁরা মনে করছেন, সূর্যবাবু বিধানসভায় যথেষ্ট ইতিবাচক। তাঁর নেতৃত্বে দলের ভাবমূর্তি আবার উজ্জ্বল হতে পারে। কিন্তু এই মতের বিরোধীদের বক্তব্য, তিনি তো স্বাস্থ্য এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী ছিলেন। সে দিক থেকে বুদ্ধবাবুর ক্ষেত্রে যে ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি’-র প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে, সেই একই যুক্তিতে সূর্যবাবুও নতুন অপরীক্ষিত মুখ নন।
নিরুপমবাবু ধীরস্থির-বিচক্ষণ। কিন্তু তিনি বুদ্ধবাবুর মতো সাধারণ নাগরিক সমাজের কাছে ঠিক ততটা গ্রহণযোগ্য নন। কেউ কেউ তাঁকে দলে সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে মমতার সরকার সাঁইবাড়ি মামলায় কী অবস্থান নেয়, তা নিয়ে তৃণমূলের রাজনৈতিক জলঘোলা করার পরিকল্পনা আছে কি না, সেটাও বুঝতে আগ্রহী সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। বিমানবাবু ‘সৎ’ এবং ‘ভাল মানুষ’ বলে পরিচিত। কিন্তু দলের বহু নেতা বলতে শুরু করেছেন, এই রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভাল মানুষ নয়, চাই এক জন কৌশলী চাণক্য। যেমনটা ছিলেন অনিল বিশ্বাস। গৌতম দেবের বয়স তুলনামূলক ভাবে কম। তিনি যথেষ্ট সক্রিয়। আক্রমণাত্মক বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু বামফ্রন্টের শরিকরা আবার তাঁর বিরুদ্ধে। দলেরও একটা বড় অংশ গৌতমবাবুর রাজনৈতিক কৌশলের বিরোধিতা করছেন। আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা তো ভোটের পর বলেই দিয়েছিলেন, ‘এই রাজনীতিতে টেলিভিশনের টিআরপি বেড়েছে কিন্তু আমাদের ভোট কমেছে।’
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর ১৮ জন সদস্যর মধ্যে বিমান-বুদ্ধ-নিরুপম-সূর্য-গৌতমকে বাদ দিলে যাঁরা আছেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়েও বহু প্রশ্ন। বিনয় কোঙার অসুস্থ। আরও বেশ কয়েক জন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এই নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যেও আরও সমন্বয় প্রয়োজন। এই সমন্বয় না থাকায় কাকে সামনে রেখে হারানো জমি উদ্ধারের যুদ্ধে নামা যায়, তা নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে না। ফলে রাজ্য নেতারা আরও বেশি করে পার্টি কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। পরবর্তী কাণ্ডারী নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রকাশ কারাটের ভূমিকা। ঠিক যে ভাবে বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ কলহে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.