একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে থিমের বৈচিত্র্য। নৈহাটির কালীপুজোর প্রস্তুতি এই দু’য়ের রসায়নে জমজমাট।
গঙ্গার ধার থেকে স্টেশন পর্যন্ত নৈহাটি অরবিন্দ রোডের কালীপুজোয় প্রাচীনত্ব আর ঐতিহ্যই বৈশিষ্ট্য। বিশাল প্রতিমা মূল্যবান গয়নায় সুসজ্জিত। বৈষ্ণবমতে নির্দিষ্ট উপাচারে পুজো ও নিরঞ্জন হয়। নৈহাটির সবথেকে জাগ্রত কালী বড়মা নামে পরিচিত। অরবিন্দ রোডে গঙ্গার ধারে কদমতলায় পূজিতা হন গ্রীন কালী। বাজারের মধ্যে বড়মা’র অধিষ্ঠান। তারপরে হকার্স কালী। হকাররাই এই পুজোর উদ্যোক্তা। দু’কদম এগোলে প্রভাত কালী, গাঁজা কালী, বেচা কালী। কালীপুজোর দিন এই পথে হাঁটলে মনে হবে যেন কালী প্রতিমার মেলা বসেছে।
নৈহাটির সবথেকে পুরনো ৮২ বছরের বড়মার প্রতিমা হয় ১৪ হাত মাপের। উদ্যোক্তারা জানালেন, বেশিরভাগ প্রতিমাই শ্যামাকালী হলেও কুচকুচে কালো এই প্রতিমা বামাকালী। ভবেশ চক্রবর্তী নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বড়মা’র পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। হাজার হাজার ভক্ত এখানে মানত করেন। নৈহাটির বিখ্যাত সন্দেশ ভোগ দেন। পুজোর দিন দামী গয়না পরানো হলেও বিসর্জনের সময় তা খুলে নেওয়া হয়। বদলে পরানো হয় সম পরিমাণ ফুলের গয়না। এরপরে ট্রলিতে করে বিশালাকায় প্রতিমা গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনেও বড়মা’ই সবার আগে। বড়মা’র পরে বাকি প্রতিমার নিরঞ্জন হয়।
অরবিন্দ রোডের আরও দু’টি দীর্ঘাঙ্গী কালীপুজো - তেমাথা মোড়ের রামু কালী ও মাছ বাজারের কাছে মেছো কালীর পুজো এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে উচ্চতার দিক দিয়ে সব থেকে বড় প্রতিমাটি হল পুরনো বিডিও অফিসের কাছে দেউলপাড়া অধিবাসীবৃন্দের। ২৯ হাত উচ্চতার এই প্রতিমার পুজো শেষে একসময় দমকলকে ডাকা হত মূর্তিটি গলাতে। এখন উদ্যোক্তারাই পাম্প চালিয়ে প্রতিমার মাটি গলিয়ে মা’কে বিসর্জন দেন। কথিত এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা হরিবালা ঘোষ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে প্রতি বছর এক হাত করে প্রতিমার উচ্চতা বাড়াতেন। ২৯ হাত হওয়ার পরে তিনি ফের স্বপ্নাদিষ্ট হন এই মাপই স্থায়ী করার।
দেউলপাড়ার কাছেই ৬ বিজয়নগরে নিউ স্টার ক্লাবের পুজোয় থিমের মণ্ডপ, প্রতিমাও থিমের। গোটাটাই বাঁশ দিয়ে তৈরি। ঝাড় লন্ঠন, নাট মঞ্চ এমনকি প্রতিমার চুল পর্যন্ত বাঁশের ছাল দিয়ে তৈরি। কৃষ্ণ ও কালীর বিভিন্ন রূপ দেখা যাবে এখানে। চন্দননগরের আলো। স্টেশনের কাছে নৈহাটি স্বামীজি সংঘের মণ্ডপের যাবতীয় উপকরণ নারকেল গাছের বিভিন্ন অংশের। ৭ বিজয়নগর অধিবাসীবৃন্দ কাঠগোলা পুজোকমিটির থিম তাল গাছ। আয়লা বিধ্বস্ত অঞ্চলের ২৫ জন শিল্পীকে এনে প্রায় এক বছর ধরে তাল গাছের বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ, তোরণ। ৬১ বছরের এই পুজো এ বার কিছু গৃহহারা মানুষের অন্ন সংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে। নৈহাটি মিত্রবাগানের গোপাল স্মৃতিসঙ্ঘের পুজোয় মণ্ডপ তৈরি হয়েছে শিব মন্দিরের আদলে। আলোয় উঠে এসেছে পরিবেশ দূষণ। লিচু বাগানের মাঠে একসঙ্গে দু’টো পুজোর একটিতে বেতের মণ্ডপ। অন্যটি ভারত সঙ্ঘের পুজো। প্লাইয়ের উপর ধানের তুষের মণ্ডপ। গঙ্গার ধারে অক্ষয় স্মৃতি সঙ্ঘের মণ্ডপে থার্মোকলের কাজ নজর কাড়বে।
সব মিলিয়ে নৈহাটিতে পঞ্চাশটিরও বেশি পুজো হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের আশা, ঐতিহ্য আর থিমের মেলবন্ধন দেখতে এ বারও উপচে পড়বে ভিড়। |