মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য • কলকাতা |
ধরুন ভারতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর। আর সেটার সুষ্ঠু আয়োজনের জন্য দিনভর ছুটছেন সচিন তেন্ডুলকর। কিংবা বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সব হ্যাপা এসে পড়েছে ভাইচুং ভুটিয়ার ঘাড়ে। অথচ দলে তাঁদের নিজেদের জায়গাটাই অনিশ্চিত এবং হা-হুতাশের ফুরসতটুকুও নেই।
এই মুহূর্তে তাঁর অবস্থাটা এ রকমই। বরকর্তার থেকেও বেশি ব্যস্ত। বরের থেকেও বেশি নার্ভাস!
তিনি, ভারতের ঐতিহাসিক গ্রাঁ প্রি-র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর ও কারিগরি পরামর্শদাতা করুণ চন্দোক। যাঁর নিজের কথায়, “পাগল পাগল লাগছে। মাঝে মাঝে তো নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যাচ্ছি!” সত্যিই ভুলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ‘ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া’-কে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার গুরুদায়িত্ব পড়েছে তাঁর উপর। ভারতীয় রেসকে “বিশ্বের সামনে আমাদের দেশের অসাধারণ বিজ্ঞাপন” বলেই কাজ সারা নয়। নয়ডার বুদ্ধ সার্কিট গড়ে ওঠার প্রতিটা ধাপের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। আর এখন? সার্কিটের তদারকির থেকে শুরু করে ফর্মুলা ওয়ান নিয়ে ভারতীয়দের ওয়াকিবহাল করা, রেসের প্রচার, স্পনসরদের আবদার-- সব সামলাতে হচ্ছে। এমনকী ভারতে বাঘ দেখার সুলুক-সন্ধান পর্যন্ত বাতলে দিতে হচ্ছে তাঁকে!
বাঘ?
সোমবার দুপুরের সামান্য ফুরসতে আনন্দবাজারের সঙ্গে টেলিফোন আলাপচারিতায় করুণ এক শব্দের প্রশ্নটায় হেসেই ফেললেন। তার পর বললেন, “হ্যাঁ, বাঘ। ভারতীয় রেসের তারিখ ঠিক হওয়ার পর থেকে ফর্মুলা ওয়ান সার্কিটে প্রত্যেকের মুখে একটাই প্রশ্ন, ভারতে গিয়ে কী করে বাঘ দেখা যায়? আমি সবাইকে রনথম্ভর যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। নয়ডা থেকে ওটাই সব থেকে সুবিধেজনক হবে মনে হয়।”
ফর্মুলা ওয়ান চালকদের ভারত-অভিযানের তালিকায় বাঘের পরেই জবরদস্ত উৎসাহ ভারতীয় খানা-পিনায়। ভারতীয় সংস্কৃতি তিনে। থাক না তেল মশলা নিয়ে আতঙ্ক আর ‘দিল্লি বেলি’-র জুজু। করুণ বলছিলেন, রসনার তাড়নায় ‘কুছ পরোয়া নেই’ বলে সাহসী হতে চান অনেকেই। তাঁর নিজের দল লোটাস রেসিং-এর সবাই তো বটেই, অন্য টিমগুলোর অনেকেই আগাম দরবার করে রেখেছেন- ‘‘ভাল জায়গায় খাওয়াতে হবে কিন্তু।’’ আর বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলার সবচেয়ে ধনী তারকাদের জন্য নিজের মনপসন্দ ধাবার কথাই সবার আগে ভেবে রেখেছেন করুণ। “আমি কোনও কালেই পাঁচ-তারা ক্রুইজিনের ভক্ত নই। ভারতীয় খাবারের আসল স্বাদ তো মেলে ধাবায়, রাস্তার দোকানে।” এসি মার্কেটের ‘গোলগাপ্পা আর চাট’ আর খান চাচার দোকানের ‘কাঠি রোল’ও রয়েছে তাঁর তালিকায়। নিজেকে কি ভোজনরসিক বলবেন? করুণের জবাব, “আরে ভারতীয় মানেই তো ভোজনরসিক! আমি ব্যতিক্রম হই কী করে?”
নিজেকে গড়পড়তা ভারতীয় বলাতেই স্বস্তি ফর্মুলা ওয়ান তারকার। আর পাঁচজনের মতোই দীপাবলির দিনটা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চান। “কিন্তু এ বার আমার ওয়ার্কিং দিওয়ালি। সে দিনও তিনটে ফটোশু্যট রয়েছে।” সামান্য অভিযোগের সুর কি? এক দিনে ছাব্বিশটা সাক্ষাৎকার দেওয়ার রেকর্ড থাকলেও এ ভাবে একটানা দু’সপ্তাহ ধরে প্রচার করতে হয়নি আর কোনও রেসে। রবিবার ভোরে ছিল রোড-শো। সন্ধ্যায় স্পনসরের অনুষ্ঠান। আজও সমান ব্যস্ত। তারই মধ্যে খুচরো ঝামেলা, কাজ করছে না আই-প্যাডের থ্রি-জি। কল সেন্টারে কেউ ফোন ধরছে না বলে আরও সমস্যায়। “আজও রাত দশটার আগে ছুটি নেই,” একটু যেন ক্লান্ত বুদ্ধ সার্কিটের বিপণন দূত।
২০১০-এর এপ্রিলে নয়ডার যে ধু-ধু প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন করুণ, আজ সেখানেই বুদ্ধ সার্কিট। তার পর থেকে “প্রতি মাসে এসেছি, কাজের প্রতিটা ধাপের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছি।” ফর্মুলা ওয়ান মরসুমের ব্যস্ততার মধ্যে এত দায়িত্ব নেওয়াটা কঠিন হয়নি? করুণের জবাব,“আরে আমি তো এখন লন্ডন থেকেও ডেলি প্যাসেঞ্জারিতে ওস্তাদ। এ বছর বার চারেক ভোরের ফ্লাইটে এসে রাতের ফ্লাইটে ফিরে গিয়েছি শুধু এই কাজের জন্য।”
পরিশ্রমের ফসল দেখে মহা গর্বিত। “লিখে রাখুন, এখানে ঘণ্টায় ৩৪০ কিলোমিটার গতি উঠবে। দারুণ ট্র্যাক হয়েছে।”
রেস সফল ভাবে উতরে দেওয়ার দায় ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছেন। অথচ রেসে তাঁর নিজের নামা এখনও অনিশ্চিত। করুণ যা ইঙ্গিত দিলেন, তাতে প্রথম ভারতীয় গ্রাঁ প্রি-তে চালানোর স্বপ্নটা খুব সম্ভবত অধরাই থেকে যাবে। স্বীকার করে নিলেন, “মোটেই আদর্শ পরিস্থিতি নয়। যে কোনও ক্রীড়াবিদের কাছে দেশের মাটিতে নিজের দেশবাসীর সামনে খেলাটাই জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি, সব থেকে অবেগের মুহূর্ত। আমিও স্বপ্নটা দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা সম্ভবত সত্যি হচ্ছে না। তবে আমি পেশাদার। নিজের চুক্তি আর দলের সিদ্ধান্তকে তো সম্মান করতেই হবে।” তাই পরের মরসুমের বৃহত্তর ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনকে শক্ত করছেন। বলছিলেন, “বাহরিনে যে দিন ফর্মুলা ওয়ানে প্রথম নামি, সেটা ছিল জীবনের সবথেকে বড় দিন। পরের বড় ঘটনা হবে যে দিন একটা ফর্মুলা ওয়ান রেস জিতব। আমি আশা ছাড়ার পাত্র নই।”
শুক্রবার বুদ্ধ সার্কিটে টেস্ট ড্রাইভিং করতে নামবেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে বদ্ধপরিকর করুণ বললেন, “বুদ্ধ সার্কিটে টেস্ট ড্রাইভ করব। সেটাই বা কম কী?”
স্বপ্ন-ভঙ্গে মুষড়ে পড়ারও সময় নেই যে বরকর্তার। না কি বরের? |