সাধারণ পাড়ায় একটা ছিমছাম বাড়ি। যেখানে বাচ্চাগুলো ইচ্ছেমতো ঘুরঘুর করবে, দরকারে পড়শিদের বাড়িতেও ঢুকে পড়বে। আর কী চাই?
নাহ্, স্টিভ জোবস আর কিছু চাননি। তাঁর অ্যাপল-সাম্রাজ্য দুনিয়া জুড়ে ডালপালা মেলে যতই জাঁকিয়ে বসুক, জোবস কিন্তু নিজের শেকড়টা হারাতে চাননি। “টাকা যেন আমার জীবনটা শেষ করে দিতে না পারে।” জীবনীকার ওয়াল্টার ইসাকসনকে বলেছিলেন তিনি।
অ্যাপলের প্রাণপুরুষের মৃত্যুর ১৯ দিনের মাথায়, আজ প্রকাশিত হল সেই জীবনী ‘স্টিভ জোবস’।
বইয়ের কিছু কিছু অংশ দিন কয়েক ধরেই উঠে আসছিল ইন্টারনেট আর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তাতে যদিও জোবস-ভক্তদের কিছু যায়-আসে না। আজ তাঁরা কেউ দোকানেই বই খুলে পড়তে বসে গিয়েছেন। কেউ এক কামড় খাওয়া আপেল বইয়ের ওপর রেখে ছবি তুলেছেন। ফুল দিয়ে সাজানো তাকে রাখা বেশ কিছু জোবস-জীবনীর গায়ে ‘রিজার্ভড কপি’ স্টিকার সাঁটা। অর্থাৎ ওই বইটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে আগেই, দোকানে স্রেফ সাজানো রয়েছে।
অথচ এমন নয় যে কোনও অ্যাপল-পাগলকে নতুন করে শোনাতে হবে জোবসের জীবনের গল্প। তা সত্ত্বেও দুনিয়ার নানা প্রান্তের বইয়ের দোকানের ভেতরে-বাইরে যে অনেকটা অ্যাপলের নয়া যন্ত্র বাজারে আসার দিনগুলোর মতোই ছবি দেখা যাচ্ছে, তার হয়তো দু’টো ব্যাখ্যা হয়। এক, চিরপরিচিত রহস্যময় জোবস-জাদু। দুই, এখনও না-জানা কাহিনির খোঁজ। এবং সেটা যদি স্বয়ং জোবসের উদ্ধৃতিতে শোনা যায়, তা হলে তো কথাই নেই!
বড়লোক হওয়া নিয়ে জোবসের জীবনদর্শন তেমনই এক না-জানা গল্প। যেখানে তিনি আক্ষেপ করেন হাতে কাঁচা টাকা আসার পরে তাঁর কিছু সাদামাটা সহকর্মীর ‘দেখনদার’ হয়ে ওঠা নিয়ে। তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, টাকা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে জীবনটাকে শেষ করবেন না কিছুতেই।
বরং বলা যায়, অনেক সময়েই ব্যবসায়িক চিন্তার আগে দৌড়ত তাঁর আবেগ। তাই যখন ভেবেছিলেন যে আইফোনের প্রযুক্তি ‘টুকে’ গুগ্ল অন্যান্য স্মার্টফোনে ব্যবহারযোগ্য অপারেটিং সিস্টেম ‘অ্যান্ড্রয়েড’ বানিয়েছে, ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এটা চুরি। অ্যান্ড্রয়েডকে শেষ করতে দরকারে পরমাণু যুদ্ধ বাঁধাব। অ্যাপলের চার হাজার কোটি ডলারের শেষ পেনিটাও খরচ করে ফেলব!” অথচ এই পাহাড়প্রমাণ রাগই তিনি সরিয়ে রাখলেন যখন গুগ্লের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ সিইও হিসেবে ভার নেওয়ার আগে তাঁর কাছেই পরামর্শ চাইতে এলেন। জোবসের মনে পড়েছিল, অ্যাপলের গোড়ার দিকে তিনিও তো এই ভাবেই ‘টিপস’ চাইতে যেতেন নানা সংস্থার কর্তাদের কাছে। |
হাতে আপেল নিয়েই স্টিভ জোবসের জীবনী কেনার লাইনে।
তাইপেইয়ের একটি বইয়ের দোকানে। ছবি: এএফপি |
তবু জীবনীকার কিন্তু একাধিক বার জোবসকে বলছেন ‘বদমেজাজি’। যিনি মনের মতো জিনিসটা না পেলে কাউকেই দু’কথা শোনাতে ছাড়তেন না। সব কিছুকেই আদ্যন্ত নিখুঁত করে গড়ার অভ্যেসটা পেয়েছিলেন তাঁর পালক পিতার থেকে। আর যন্ত্র নিয়ে পাগলামোটা ছিলই। তবে জোবসের নিজের মতে, ১৯৭০ সালে সাত মাসের ভারত সফরটারও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে তাঁর জীবনে। “ভারত থেকে নিয়ে ফিরেছিলাম অন্তর্দৃষ্টি।” বলেছিলেন তিনি। ওই সফরেই তাঁকে টানে জেন বৌদ্ধধর্ম। জীবনীকারের মতে, “বৌদ্ধধর্মের সারল্য ছাপ ফেলেছিল জোবসের সৃষ্টিশীলতায় যেটা যত সহজ, সেটা তত কেতাদুরস্ত।” বলা বাহুল্য, জোবসের যন্ত্রগুলো তো এমনই!
শেষ জীবনে ভাবছিলেন, আইফোন, আইপ্যাডের মতো টিভি নিয়েও বৈপ্লবিক একটা কিছু করবেন। হয়ে ওঠেনি। ইসাকসনকে বলেছিলেন, মারণ-ব্যাধি থেকে বাঁচার কোনও একটা ওষুধ আছে বলে আশা করছেন। বলেছিলেন, “ক্যানসার হওয়ার পর থেকে ঈশ্বরের চিন্তাটা বেশি হয়। ভাবি, মৃত্যুতেই হয়তো সব শেষ হয়ে যায় না। আবার কখনও এ-ও মনে হয়, ব্যাপারটা একটা সুইচের মতো। ‘অফ’ হল, আর তুমি শেষ!”
আর তাই অ্যাপলের যন্ত্রগুলোয় অন-অফ সুইচ লাগাতে তাঁর মোটেও ভাল লাগত না। গত অগস্টে ইসাকসনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে নিজেই সে কথা বলে গিয়েছেন স্টিভন পল জোবস। |