কথোপকথন
ডাক্তারের ‘ড’ অভিনয়ের ‘অ’
৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, সারা ভারতে জাগরণ সৃষ্টি হল। একটা লোকই তো ছিলেন, যিনি ৩৬ কোটি লোককে এক পতাকার তলায় আনতে পেরেছিলেন মহাত্মা গাঁধী, জাতির পিতা। ১৯৪২-এ আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত স্টুডেন্ট ইউনিয়নের হয়ে কাজ করতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। একেবারে ঠিক পুজোর মুখে আমাদের সাত জনকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পুরে দিল। এই ছিয়াশি বছর বয়স পর্যন্ত ওই বছরটা ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনও দিন পুজোর সময় ঘরের বাইরে কাটাইনি। জীবনে ওই এক বারই। এমন হয়েছে যে, যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল, দু’দিন কলকাতায় থাকলে, দু’দিন দেশে থাকতাম পুজোর সময়। আর এক বার মনে পড়ে, ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ ছবির শুটিংয়ে আমরা নর্থ বেঙ্গল যাব। সত্যজিৎ রায় আমায় বললেন, ‘পুজোর সময় শুটিং হবে, পুজোর পরে ফেরা হবে।’ মানিকদাকে বললাম, মানিকদা, এই শিডিউলটা কি আগে-পরে করা যায় না? আসলে আমি তো পুজোর সময় বাড়িতে থাকি। বললেন, ‘ঠিক আছে, তা হলে পুজোটা এনজয় করে আমরা বিজয়া দশমীর দিনেই যাব।’
ছেলেবেলার পুজোগুলো খুব এনজয় করেছি। বাবা কলকাতা থেকে নতুন জুতো নিয়ে গেলে, রাতে সেগুলো বালিশের তলায় নিয়ে ঘুমোতাম। যাতে কেউ না পরে ফেলে। এক বার পুজোতে পাড়ার দোকান থেকে চোদ্দো আনা দিয়ে একটা ফুলহাতা ফুলছাপ শার্ট কিনেছিলাম। সেই দেখে বাবা খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না তো। তাই বাবা বলেছিলেন, ‘আমি ন’আনার জামা কিনে তোমাদের বড় করলাম, তুমি কিনা চোদ্দো আনা দিয়ে জামা কিনেছ। শুধু শুধু পয়সার অপচয় করছ।’
ঋত্বিক ঘটক আমার থেকে দু’দিনের বড়, আর উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় ২ মাস তিন দিনের। জন্মেছিলাম ৬ নভেম্বর ১৯২৬ সালে ‘দর্শনা’ নামক জায়গায়। কলকাতা থেকে যেতে গেলে বাংলাদেশের প্রথম স্টেশন। বাবা স্টেশন মাস্টার ছিলেন। তিনি অবসর নেন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭-এ। বাবার উদ্দেশ্য ছিল, এমন একটা জায়গায় বাড়ি করবেন, যেখানে ম্যালেরিয়া থাকবে না। খুঁজে পেলেন ‘কুষ্ঠিয়া’ বলে একটা জায়গা। যেখানে রেল লাইন আছে, নদী আছে, ইন্ডাস্ট্রি আছে (মোহিনী মিলস বলে একটা কাপড়ের কল ছিল) কিন্তু ম্যালেরিয়া নেই। কুষ্ঠিয়ার স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হই, তার আগে চুয়াডাঙার ভিক্টোরিয়া জুবিলি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম।
এইখানেই পড়তে পড়তে অজান্তে কী করে যেন, নাট্যভাব জন্মাল। ওখানে মোহিনী মিল কর্তৃপক্ষ বছরে দু’বার কলকাতা থেকে যাত্রা দল নিয়ে যেত। সেই যাত্রা দেখে দেখেই মনে হয় আমার মধ্যে একটা অভিনয় করার স্পৃহা জাগল। যাত্রাটা বেশ এনজয় করতাম। সাতপুরুষে আমার বংশে অভিনয় জগতে কেউ ছিলেন না। সবাই সরকারি চাকুরে ছিলেন। এর পাশাপাশি স্কুলে-ক্লাবে নারী চরিত্র বর্জিত নাটক হত, তাতে চেয়েচিন্তে পার্টটার্ট করতাম। তখন চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে নাটকের রিহার্সাল করতাম। মনে পড়ে ১৯৪৭ সালের ১৬ অগস্ট ‘মহারাজা নন্দকুমার’ নাটক করেছিলাম মাত্র দু’দিনের রিহার্সালে।
বয়স তখন ১৭। হায়ার করে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী একটা গ্রামে। সেখানে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক হবে। স্থানীয় দাদারা বলল, ‘চাণক্যটা এ বার তুই কর।’ বললাম, এই বয়সে চাণক্য করব? এটা কী করে সম্ভব? বলল, ‘সবই সম্ভব। গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকানে চলে যা, ওখানে শিশিরবাবুর রেকর্ড আছে, ওটা কিনে শোন। তা হলেই হয়ে যাবে।’ ১৭ বছর বয়সে চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্য করেছিলাম। প্রশংসাও পেলাম। যা-ই হোক, এই সব করতে করতে কী করে যেন স্বদেশি জাগরণ মনের মধ্যে ঘটে গেল। মনে আছে, সেভেন কী এইট থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত দুটো কাজ পাশাপাশি করে গিয়েছি। নাটক, সেটা যেখানেই হোক আর সে যে নাটকই হোক। আর দ্বিতীয়টা হল স্বদেশি করা। সেটা কী করে অ্যাক্টিভলি আমার ভিতর ঢুকে গেল, বুঝলাম না। মিটিংমাটাং, মিছিল, আন্দোলন পুরোদমে চালিয়ে যেতাম।
লেখাপড়াটাকে সে ভাবে মেনে নিতে পারিনি। দিনগুলো জনসেবা, স্বদেশি, থিয়েটার নিয়ে খুব আনন্দেই কাটছিল। আর সেই কারণেই বাড়ির লোক আমার উপর রেগে ছিলেন। বাবা মাকে বলেছিলেন, ‘হি ইজ মাই স্পয়েল্ট চাইল্ড। কিচ্ছু হবে না। আমার উদগ্র বাসনা ছিল ওকে ডাক্তার করব, এত সুন্দর চেহারা, কিন্তু ডাক্তারের ড-ও দেখতে পাচ্ছি না ওর মধ্যে।’
জেলে যাওয়ার পর বাড়ির সবার চক্ষুশূল হয়ে গেলাম। সবাই বলতে লাগল এ হল বংশের জেলখাটা ছেলে! বাবার তখন চারটি কন্যার বিবাহ দিতে বাকি। সঞ্চয় খুব কম। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিলাম, রেজাল্ট বেরল, তখন বাবা-মার ও আত্মীয়দের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলকাতায় চলে এলাম। ভাগ্যন্বেষণের উদ্দেশ্যে।
কলকাতায় আমার ভগ্নিপতি কাজ করতেন কাশীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে। আমার কাশীপুর গান-শেল ফ্যাক্টরিতে একটা চাকরি হয়ে গেল। মহানন্দে চাকরি করতে থাকি। হাতখরচের জন্য কিছু রেখে, রোজগারের বাকি টাকা বাবা-মাকে পাঠাতে শুরু করলাম। তখন ২৪ ঘণ্টা কাজ করা যেত। পাঁচ মাস কাজ করার পর আমায় চাকরি থেকে একপ্রকার গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হল বলতে পারো। কারণ হিসেবে জানানো হল, আমি নাকি স্বদেশি করে খুব অন্যায় করেছি। জেলখাটা ছেলেকে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে দেওয়া যাবে না। এটাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ।
গ্রাফিক: অরিন্দম মজুমদার
চাকরি চলে যাওয়ার পর দাদার কাছে থাকতে লাগলাম, শ্যামবাজারে। এই সময় আমার পুজোগুলো কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল কে জানে? পুজো বলে তখন কিছু ছিল না। যা-ই হোক, প্রত্যেকটা দিন শ্যামবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে চাকরির জন্যে এখানে ওখানে হন্যে হয়ে ঘুরেছি। মেজাজে স্বদেশি, চেহারাতে সাহেবি। অত্যন্ত দুদর্শার, অত্যন্ত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে ওই সময়টা। দাদা বদলি হয়ে গেলেন দিল্লিতে। মাথার ছাদটাও চলে গেল। মেস জীবন শুরু হল। একটু ভাত, সঙ্গে জলসর্বস্ব ডাল, আর মেট্রো রেলের টোকেনের সাইজের মতো একটা মাছের পিস! এই খেয়ে বাটা কোম্পানিতে সেলসম্যানের পদে যোগ দিলাম। শিয়ালদাতে অফিস। আমাদের ওখানকার লোকেরা শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন ধরে বাড়ি যায়, আর আমাকে দেখে বলাবলি করে, ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে অজাত-বেজাতের পায়ে হাত দিয়ে জুতো পরাচ্ছে! এমন সময় গিয়েছে দাড়ি কামানোর পয়সা ছিল না। আর ওই কোম্পানিতে নিয়ম ছিল, কর্মীরা যদি পরিষ্কার জুতো না পরে এবং ক্লিন শেভ্ড না হয় তবে ওই চাকরি করা যাবে না। আমার তো পয়সা নেই, কোথায় দাড়ি কামাব, শ্যামবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে অফিস যেতাম। এক দিন অফিসের বড়বাবু দেখলেন, আমার না কামানো এক মুখ দাড়ি। রেগে গেলেন, আমার দিকে দু’আনা পয়সা ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘যান, শেভ করে আসুন।’ আমিও রেগে খাপ্পা। দু’হাত দিয়ে ওই অফিসবাবুকে ওয়েট লিফ্টারদের মতো শূন্যে তুলে বলেছিলাম, আপনাকে আমি ফুটপাথে ছুড়ে ফেলে মারব। আমার চেহারা দেখে কি মনে হয়, আমি ভিখিরি? চাকরি গেল ভোগে। আসলে ছোট থেকেই আত্মসম্মানবোধটা খুব প্রখর ছিল।
আবার চাকরির জন্য হণ্টন হণ্টন আর হণ্টন। চাকরি পেলাম ডকে। ১টাকা ন’আনা রোজে। ওখানেই স্নান, খাওয়া, বাথরুম, সব। সকালে যেতাম রাত্রিতে ফিরতাম। দুপুরে খেতে তো হবে। ওই সামান্য মাইনে, তাই সস্তায় কোথায় খাবার পাওয়া যায় খোঁজ লাগালাম। ডকেরই বাইরে পূর্ববঙ্গীয় এক ভদ্রমহিলার হোটেল ছিল। ডিমের ঝোল আর ভাত, ছ’আনা। খুবই সস্তা। কিন্তু তিনি এত শুকনো লঙ্কা দিতেন ঝোলে, সেই খেয়ে রোগ গেল বেধে, অফিস কামাই হল, কাজটাও হারালাম।
এর পর একটা কাজ পেলাম আমেরিকান আর্মিতে। ১০০ টাকা মাইনে। রোল্যান্ড রোড যেখানে, ওখানে আর্মির জিপ গ্যারেজ হত। একটি চেয়ার, একটি টেবিল ও একটি টেলিফোন নিয়ে আমার সাজানো অফিস! টেলিফোনে বলা হত, অমুক জায়গায় একটা গাড়ি পাঠাতে হবে, নির্দেশ মতো গাড়ি পাঠানো আমার কাজ। এবং পার্মানেন্ট নাইট ডিউটি। যা-ই হোক, এক দিন রাত্রি ২টো বাজে। টেবিলের ওপর দু’কনুইয়ে ভর দিয়ে কপালে হাত বোলাতে বোলাতে একটু রিল্যাক্স করছি, এমন সময় দেখি আমার নিম্নাঙ্গে চেয়ারের নীচ থেকে একটা গরম ভাব আসছে। চোখ মেলে দেখি, কে বা কারা যেন চেয়ারের নীচে কাগজের পুঁটলি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখে পড়ল এক আমেরিকান সোলজার ও এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা। দু’জনেই খুব হাসাহাসি করছে, আমার ওই বেকুব অবস্থা দেখে। এবং দু’জনেই বেহেড। তাদের সঙ্গে আমার তর্কাতর্কি চলল কিছু ক্ষণ। এবং রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে দিলাম, ব্লাডি ম্যান! বলতেই দেখি মাতাল আমেরিকান ব্যাটা আমার দিকে তাক করে রিভলভারের খাপ খুলছে। ওই দেখে তো আমি থরহরিকম্পমান। সঙ্গে সঙ্গে দে দৌড় এলগিন রোডের দিকে। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, কোনও জিপ আসছে কি না, বা মাতাল সৈন্যটি আমার দিকে ধেয়ে আসছে কি না। বুঝতেই পারছ ওই চাকরিটাও গেল ফস্কে।
আবার ‘এগারো’ নম্বর গাড়িতে করে চাকরি খোঁজা, মানে ওই হণ্টন আর কী! চাকরি পেলাম বেঙ্গল টেক্সটাইলে। ওখানে অডিটের কাজ, মাইনে ৭৫ টাকা। ভাবতে লাগলাম, এই করে কী করে চলবে? কোথাও দাঁড়াতে পারছি না। নিজে কী খাব, আর বাবা-মাকেই বা কী পাঠাব? পরে ওই চাকরিও ছাড়লাম। এক পাড়াতুতো দাদার কাছে খবর পেলাম এক বিলিতি ইনসুরেন্স কোম্পানি কেরানি নেবে। ওই দাদাকে গিয়ে বললাম, একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দাও। করে দিল। গেলাম বড় বসের কাছে। পাশের চেয়ারে বসতে বলে, একটা কোশ্চেন পেপার, উত্তরপত্র দিলেন। বললেন, এখানে বসে উত্তরগুলো লিখে জমা দিন। দিলাম। দেখলাম, বাবু এক জায়গায় লাল কালির দাগ দিলেন। পারচেস বানানটা ভুল হয়েছে। pur জায়গায় per হয়ে গিয়েছিল। যা-ই হোক বড়বাবু সেই কাগজটা সাহেবের ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি তো রাগে এবং দুঃখে মৃতবৎ। কারণ, যে সাহেবদের তাড়াবার জন্য জেলে গেলাম, পেটের দায়ে সেই সাহেবের নোকরি করতে হবে। হে ঈশ্বর! সাহেব দু’একটা প্রশ্ন করলেন, কিচ্ছু বুঝতে পারিনি, কারণ, আমি তো ওদের ইংরেজি জানি না। খালি ইয়েস, নো ভেরিগুড স্যর, থ্যাঙ্ক ইউ স্যর বলে চাকরিটা পেয়ে গেলাম। সাত দিন পরে বাড়িতে চিঠি এল কাজে যোগ দেওয়ার জন্য।
ভাবলাম, এর সঙ্গে আরও কী করা যায়? পড়াশোনাও তো বিশেষ একটা করিনি। ঠিক করলাম, এই কেরানিগিরি করতে করতেই রাতের কলেজে ভর্তি হব। হলাম। এই করতে করতে রেডিয়োতে নাটক বিভাগে দরখাস্ত করলাম। তিন বার ফেল মেরে চার বারের বার পাশ করলাম। তখন বিকাশ রায় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ ছিলেন। তখন কিন্তু তিনি বিখ্যাত বিকাশ রায় হননি। অর্থাৎ চাকরি ছেড়ে ফিল্মে আসেননি। তখন তিনি বিকাশচাঁদ রায়। ডাকলেন।
শচীন সেনগুপ্ত বিরচিত একটি নাটকের কিছু অংশ পড়তে বলা হল। আমি তো তখন জানি না, কে আমার অডিশন নিচ্ছেন। উনি বললেন, ‘আচ্ছা আপনি তো এতক্ষণ বেস-এ অ্যাক্টিং করলেন, এ বার টপ ভয়েসে করুন দেখি?’ করলাম। উনি বললেন, ধন্যবাদ। আমার মনে হল এই চাকরিটা হয়ে যাবে। কারণ, এতগুলো প্রশ্ন করে অকারণে কেউ সময় নষ্ট করতেন না। ওখান থেকে চিঠি পেলাম তিন হপ্তা বাদে যে, সিলেকটেড। অমুক দিনে কাজে আসুন। দু’মাস বাদে বাদে একটা প্রোগ্রাম করি। ১০ টাকা ফি। এর পর এক দিন বিকাশবাবুকে গিয়ে বললাম, আমায় আরও কিছু প্রোগ্রাম দিন, চলছে না, বড় অভাব। উনি বললেন, ‘দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু খুব বেশি হলে বছরে এগারোটার বেশি পাবেন না।’ বললাম, তাই দিন। খুব উপকার হয়। এই করতে করতে ওঁদের নজরে এলাম। পরে অস্থায়ী অ্যানাউন্সারও হলাম। তখন রেডিয়োতে অ্যানাউন্স করতে হত চোঙা দিয়ে। এটা খুব ভাল পারতাম। আমার ভয়েসটা তো ব্রেভ। আর এই ভয়েসই আমাকে ভাল নজরে পড়তে সাহায্য করল। মোটো ছিল, যতই জুতোর শুকতালা খউক, বাড়ি ফিরে যাব না।
এই করতে করতে এক দিন রেডিয়োর অতুলকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘তুমি থিয়েটার করবে?’ বললাম, সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই করব। ‘অহীনবাবু রংমহলে একটা থিয়েটার করছেন, উনি দুটো ভাল ছেলে চেয়েছেন, তুমি যদি রাজি থাকো তা হলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাল এক বার ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করো।’ তার পরের দিন তারাশঙ্করবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখা করলাম। ঋষিতুল্য চেহারা। ছোট ধুতি, ফতুয়া, জমিদার বাড়িতে গোমস্তারা যেমন উঁচু একটি টুল নিয়ে কাজ করতেন, তেমনি উনিও ওই রকম টুলে কাগজপত্র নিয়ে লেখালিখি করছেন। গিয়ে বললাম, আমায় রেডিয়োর অতুলকৃষ্ণবাবু পাঠিয়েছেন, আপনি অভিনয়ের জন্য দুটো ভাল ছেলে চেয়েছিলেন, আমি তার মধ্যে এক জন। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অতুলকে বলেছিলাম, একটু আগেই এক জন এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গেও কথা হল। আপনি বরং কাল সন্ধেবেলা রংমহলে অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে এক বার কষ্ট করে দেখা করুন। ওই সময় আমিও থাকব, আলাপ করিয়ে দেব।’ এই শুনে তো ‘হৃদয় আমার নাচিরে আজিকে...’ অহীনবাবুকে সামনাসামনি দেখব! এত দিন যাঁকে নাটকে, ছায়াছবিতে দেখে এসেছি। এত উল্লাস হল বলে বোঝাতে পারব না। কখন সন্ধ্যা হবে। যা-ই হোক, রংমহলে ঢুকলাম দুরুদুরু বক্ষে। রিহার্সাল চলছে। এক জনকে বললাম, তারাশঙ্করবাবু অহীন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। একটু বলবেন, কোথায় গেলে পাব তাঁরে। তারাশঙ্করবাবু আমায় দেখে অহীনবাবুকে বললেন, ‘আপনি দুটো ভাল ছেলে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে এই ছেলেটি রেডিয়ো থেকে এসেছে।’ অহীনবাবু বললেন, ‘অ, দেখতে বেশ ভালই। আপনি কী করেন?’ বললাম, চাকরি করি, সঙ্গে পড়াশোনাও। ‘এত সব করে সময় মতো অভিনয় করতে পারবেন? মাসে বাইশটা শো।’ বললাম, যদি নেন স্যর, চেষ্টা করব। অভিনয় করতে খুব ইচ্ছে করে। বললেন, ‘ঠিক আছে, রোজ রিহার্সাল শুনতে আসুন।’ রোজ আসছি। হাঁটাচলা, কথাবার্তা উনি কিন্তু আড়াল থেকে সব লক্ষ করছেন। তার পর এক দিন অহীনবাবু আমাকে দেখিয়ে শচীন সেনগুপ্তকে বললেন, ‘ওই যে ওই ছেলেটি, দেখুন যদি চলে।’ শচীনবাবু স্টেজে ডেকে নামধাম, কী করিটরি, জিজ্ঞেস করলেন। তখন বসে বসে রিহার্সাল হত। তিনি বললেন, ‘রোজ আসবে রিহার্সালে। আর আমাদের যখন শো হবে, শো দেখতে যাবে।’ আমি তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। বিনা পয়সায় থিয়েটার দেখতে পাব! প্রথম নাটক ছিল ‘আবুল হাসান’। সেকেন্ড লিড রোল দেওয়া হয়েছিল। অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল নতুন লোককে দিয়ে এত ভাল রোল। তখন ‘দীপালি’ বলে একটা মঞ্চপত্রিকা ছিল। তাতে নাটকটা রিভিউ বেরিয়েছিল। তাতে আমার সম্পর্কে লিখেছিল, নবাগত হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। অভিনয় করেছেন ভাল, গলাটি আরও ভাল, চেহারাটিও মঞ্চের উপযোগী।
তার পর অনেক নাটক করেছি ‘কর্ণার্জুন’, ‘দেবদাস’, ‘কেদার রায়’ এবং বারে বারে এসেছি কলকাতার সব থিয়েটার হলগুলিতে। তিনকড়ি চক্রবর্তী, অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ছবি বিশ্বাস, সন্তোষ সিংহ, নরেশ মিত্র, সরযূ দেবী এঁদের সংস্পর্শে এসেছি। আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।
এ সময় আমাদের দেশের মোহিনী মিলস কর্তৃপক্ষ ‘লীলাময়ী পিকচার্স’ বলে একটা ফিল্ম কোম্পানি চালু করলেন। কর্ণধার ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তী। এঁরা দুটো ছবি করলেন, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত, অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দেবদূত’। ছবিটা চলল না। তার পর আর একটা ছবি ‘বিষের ধোঁয়া’, সেটা আবার আগে হিন্দিতে হয়েছিল। সেটাও সুপার ফ্লপ। তার পরে এন বি প্রোডাকশনের দুটো ছবি করি। তার পরেই হুট করে বিয়ে করে ফেললাম। জোয়াল পড়ল কাঁধে।
ঠিক এর পরেই একটা কাজ পেলাম। মধু বসু পরিচালিত ‘মাইকেল মধুসূদন’। মাইকেল করেছিলেন উৎপল দত্ত, আমি ঋষি রাজনারায়ণের রোলে। হেনরিয়েটা করেছিলেন উষা খান। যাঁকে ‘বেথুন বিউটি অব কলকাতা’ বলা হত। ছবিটা দারুণ সাকসেসফুল হল। মধুবাবুকে চিনলাম। পণ্ডিত, সাহেব ও বাঙালির একত্র সংমিশ্রণ মধুবাবু ছাড়া খুব কম বাঙালির ছিল।
এর পরে কাজ পেলাম ‘বরযাত্রী’ ছবিতে। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, আমি। ত্রিলোচন করেছিলাম। খুব নাম হল। রেডিয়োয় কাজের চাপ বাড়ার ফলে, চার বছর কোনও কাজ করলাম না। অবশ্য এর মধ্যে একটা ছবি করেছিলাম যাতে সন্ধ্যা রায় নায়িকা। ‘নাগিনী কন্যার কাহিনি’। তখন আমি বউবাজারে থাকি।
এর পর রেডিয়োর কাজের সূত্রেই আলাপ হল চারুপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে। উনি ব্যাকরণ খুলে অভিনয় করতেন। অনেক জিনিস ওঁর কাছ থেকে শেখা। একটা চরিত্র কী ভাবে সৃষ্টি করা যায়, ওঁকে দেখলেই বোঝা যেত। ওই সময় ‘অভিযান’ শুটিং হচ্ছে। তাতে চারুদা অভিনয় করছেন। এক দিন চারুদাকে বললাম, আমাকে একটু সত্যজিৎ রায়ের শুটিং দেখাবেন? অত বড় মাপের এক জন পরিচালক, উনি কী ভাবে কাজ করেন ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। চারুদা এক দিন নিয়ে গেলেন শুটিং দেখাতে। টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়োতে। চারুদা মানিকদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। উনি বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো ওকে দেখেছি। উৎপলের ‘মেঘ’-এ। ভাল আছেন? কোথায় থাকেন?’ বললাম, চারুদার বাড়ি থেকে দু’মিনিট হাঁটা দূরত্বে।
এর ঠিক এক মাস পর চারুদা বললেন, ‘এটা কাউকে বলবেন না, সত্যজিৎ রায় আপনাকে অ্যাপ্রোচ করতে পারেন।’ সে কী! ‘উনি আমাকে বলেছেন আপনার সম্বন্ধে ডিটেলস নিতে। আপনাকে খুব পছন্দ।’
কয়েক দিন পর এক সকালে েফান, ‘হারাধনদা, সত্যজিৎ রায়ের ভানু বলছি। মানিকদা এক বার আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন।’ আমি বললাম, কী? মানিকদা আমার কাছে আসবেন? না না, এটা হতে পারে না। আদেশ করলে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করে আসব। ভানু বললেন, ‘তা হলে কাল সকাল দশটার সময় চলে আসুন।’ দশটা বাজতে দশে পৌঁছে গেলাম লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজল, আমিও ডোরবেলে প্রেস করলাম। মানিকদা দরজা খুললেন। বললেন, ‘আসুন আসুন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বসুন। চা খাবেন তো?’ হ্যাঁ চা খেতে পারি। ‘এই দু’পেয়ালা চা পাঠিয়ে দাও তো।’ উনি কাপ বলতেন না। তার পর বললেন, ‘আমি নরেন্দ্র মিত্র মহাশয়ের ‘মহানগর’টা করছি। আপনি একটা পার্ট করে দেবেন?’ আমি তো ওঁর এই কথা শুনে থ! ‘করে দেবেন’ মানে? বললাম, আমি তো রেডি, এক বার বলার অপেক্ষা। আপনি আদেশ করুন, যদি পারি। উনি বললেন, ‘পারবেন। উৎপলের ‘মেঘ’-এ আপনার অভিনয় দেখেছি। আপনাকে আজ উপন্যাসটা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি এক বারই পড়বেন। তার পর স্ক্রিপ্টটা রেডি হয়ে গেলে এক দিন ডেকে পাঠাব।’ চা এল, বড় এবং স্বচ্ছ পাতলা দুটো কাপ। চা-টা বাইরে থেকে দেখা যায়। দেখি চা-টা একেবারে গঙ্গাজলের মতো কেমন যেন! ভাবলাম, খেতে ভাল হবে? আমি আবার ভাল চা না হলে খেতে পারি না। এই সব হাবিজাবি ভেবে চুমুক দিতেই চমক! পিয়োর দার্জিলিং! তার সঙ্গে বিদেশি বিস্কিট।
নিউ থিয়েটার্সে দু’নম্বর স্টুডিয়োতে শুটিং শুরু হয়েছিল ‘মহানগর’-এর। দু’দিন বাদে স্টুডিয়োয় ঢুকছি এমন সময় অনিলবাবু (মানিকদার ম্যানেজার) বললেন, ‘আপনি করেছেনটা কী?’ শুনে তো আমার ভয়ে অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়া। বলি, পারিনি, একেবারে পারিনি?
মানিকদার কাছে যেতেই বললেন, ‘আমি প্রিন্ট দেখছিলাম। খুব ভাল হয়েছে। কিপ ইট আপ। যান পোশাক পরে নিন।’ ওঁর ছবিতে তো কোনও মেক-আপ ছিল না। তার পর একে একে ‘কাপুরুষ-মহাপুরুষ’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’। মানিকদার সঙ্গে লাস্ট কাজ ‘শাখাপ্রশাখা’।
এর পর তপন সিংহ, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার সবার সঙ্গে কাজ করেছি। উৎপল দত্তের সঙ্গে পরিচয়টা হয়েছিল আমার দেশের দুই দাদার মারফত। ‘ফেরারি ফৌজ’-এ এক অত্যাচারী দারোগার চরিত্রে অভিনয় করলাম। উৎপলবাবু বলতেন, এটা নাকি ওঁর বাবার চরিত্র। ওঁর বাবা পুলিশের ডিআইজি ছিলেন। এই ‘ফেরারি ফৌজ’-এর অভিনয়ই আমাকে শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা অ্যাওয়ার্ড এনে দেয়। ১৯৬১ সালে। তার পর ‘ভিআইপি’ নাটক করলাম। এই ‘ভিআইপি’ নাটকই আমার স্টেজ পারফরম্যান্সে সব থেকে কঠিন চরিত্র ছিল বলে মনে করি। কারণ, চার মিনিট অন্তর স্টেজে আসতে হত হুইল চেয়ারে করে। এক পাগলাটে ইনটেলেকচুয়ালের ভূমিকায়। আমার মনে হয় ‘ভিআইপি’ নাটকে এবং ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ ছবিতে রোল দুটো সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল।
এখন পুজোগুলো একপ্রকার আমাদের কম্পাউন্ডেই কাটে। এখানেই পুজো হয়। সপ্তমীর দিনে আধ ঘণ্টার জন্য নীচে যাই, মায়ের কাছে। তার পর ফিরে এসে বই পড়ি, গান শুনি। তবে এই বয়সেও ফিতে কাটতে যেতে হয়। এটা আমাদের এখন প্রফেশন বলতে পারো। চতুর্থী বা পঞ্চমী থেকে একেবারে কালীপুজো অবধি এই ফিতে কাটাকাটি চলে। যা বললাম এতে কি তোমার লেখা দাঁড়াবে? সব্বাই ভাল থেকো, সকলে সক্কলকে ভালবেসো, পুজো এনজয় করো। আর কী!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.