চতুর্দশী না পড়লে দেবীর চক্ষুদান হয় না। চক্ষুদানের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবীকে বেদিতে তোলা হয়। বহু বছর ধরে এটাই রেওয়াজ কালনা শহরের মেজকালী পুজোয়।
শহরের বড়, মেজো ও ছোট কালীর পুজো নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। বহু বছর আগে ভাগীরথীতে দেবীর বিসর্জনের আগে তিনটি মূর্তিকে মাপার পরেই না কি এই নামকরণ করা হয়। শহরের শ্যামলাল পাড়ার সাহা পরিবারে পূজিত হন মেজোকালী। দেবীর উচ্চতা ১২ ফুট।
|
কালনার সাহা পরিবারের
মেজোকালী। নিজস্ব চিত্র |
পরিবারের সদস্যদের দাবি, পুজো শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচশো বছর আগে। তবে এই দেবী প্রথম পুজো পান নদিয়ার কালিয়াডাঙার হরনদী গ্রামে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে সাহা পরিবারে পুজো শুরু করেন সাগররঞ্জন সাহা ও তাঁর বউদি আনন্দময়ী সাহা। জনশ্রুতি, প্রথমবার পুজোয় দেবীকে সন্তুষ্ট করতে নিয়ে আসা হয় কালো রঙের পাঁঠা। বলির আগে তাকে শক্ত খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। কিন্তু বলিদানের সময় দেখা যায়, পাঁঠা নেই, পড়ে রয়েছে শুধু দড়ি। সকলের ধারণা হয়, ‘মা বলি চান না।’ তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় বলি।
হরনদী গ্রামের ভাগীরথীর পাড়ে ছিল সম্ভ্রান্ত সাহা বাড়ি। কালী পুজোর জন্য আলাদা করে মন্দির তৈরি করা হয়। ভাগীরথী গর্ভে সব কিছু তলিয়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্য হরকালী সাহার ছেলে সুরেন্দ্রনাথ সাহা চলে আসেন কালনা শহরে। তিনিই শ্যামলাল মহল্লায় নতুন করে দেবীর আরাধনা শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথবাবুর পুত্র সন্তান না হওয়ায় পরবর্তিকালে তাঁর মেয়েরাই পুজোর দায়িত্ব নেন।
সাহা পরিবারের সদস্যরা এখনও প্রাচীন রীতি মেনেই পুজো করে চলেছেন। নিয়ম মেনে চতুর্দশীর দিন দেবীর চক্ষুদান করা হয়। এর পরে দেবীকে বেদিতে তোলা হয়। নিয়ম মেনে সাত জন মহিলা দেবীকে বরণ করেন। পুজোর প্রথম দিন দেবীকে উৎসর্গ করা হয় ২১টি নৈবেদ্য। এ দিন সেবাইতদের এক জন সংকল্প করার পরেই শুরু হয় পুজো। বিজয়ার দিন ওই সেবাইতই রূপোর থালায় সুপারি, পান, কলা, পৈতে দিয়ে দেবীকে করেন ও প্রার্থনা করেন, ‘পরের বছর আবার এসো মা।’ পুরনো রীতি মেনে প্রতিমা ভাগীরথীতে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।
পারিবারিক এই পুজোর একটি রীতি অবশ্য ভেঙেছে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিসর্জনের দিন দেবীকে ভাগীরথীর ঘাটে নিয়ে যেত ৩০ জন বাহক। এখন সেই নিয়ম ভেঙে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় নীচু গাড়িতে। পরিবারের সদস্য অমলকুমার সাহা বলেন, “রাস্তার চারিদিকে বিদ্যুৎ ও কেবলের তার রয়েছে। কাঁধে চড়িয়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ায় সমস্যা হত। তাই নীচু গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
এখন প্রাচীন এই পুজো শুধু পরিবারে সীমাবদ্ধ নয়, পুজো উপলক্ষে অনেক দূর থেকে মানুষজন দেবী-দর্শনে যান। আর সাহা পরিবারের সদস্যরা সারা বছর বিচ্ছিন্ন থাকলেও পুজোর দু’দিন এক সুতোয় বাঁধা পড়েন। |