শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাঙের ছাতার মতো শ্রমিক ইউনিয়ন যাতে গজিয়ে না-ওঠে, সে জন্য এ বার কঠোর ব্যবস্থা নিতে চাইছে রাজ্য সরকার। এবং তারই অঙ্গ হিসেবে রাজ্য শ্রম দফতর নতুন ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশনের পদ্ধতিতে তীক্ষ্ন নজরদারি শুরু করেছে। পাশাপাশি নথিভুক্ত সংগঠনগুলোর ঘোষিত সদস্যসংখ্যা ঠিক কি না, তা যাচাই করার বিলুপ্ত প্রথাও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার।
বিশেষত চটকল ও বিড়িশিল্পে একাধিক শ্রমিক ইউনিয়নের উপস্থিতি নিয়ে প্রশাসন বিস্তর সমস্যায় পড়েছে। শ্রম দফতরের এক কর্তার কথায়, “দেখা যাচ্ছে, এই দুই শিল্পে উদ্ভুত বিভিন্ন শ্রম-সমস্যার সমাধানে সরকার ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকলেই শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে এত বেশি লোক চলে আসছেন যে, তাঁদের বসার জায়গা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না!” আবার একটা কারখানায় একাধিক সংগঠন থাকায় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে দর কষাকষির (বারগেনিং) আসল অধিকার কার, সেটাও অনেক সময়ে পরিষ্কার হয় না বলে জানিয়েছেন সরকারি একাধিক কর্তা।
শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও বলেন, “অনেক জায়গায় দেখেছি, চটকলের মালিকই নিজেদের সুবিধার জন্য ইউনিয়ন তৈরি করিয়েছেন। তা ছাড়া সদস্যসংখ্যার নিরিখে জাতীয় স্তরের কয়েকটা সংগঠন এক নম্বরে থাকলেও এ রাজ্যে শ্রমিকদের মধ্যে তাদের তেমন উপস্থিতি নেই। তবু দেখা যায়, ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় তারাও আসছে।” শ্রমমন্ত্রী বৃহস্পতিবার মহাকরণে বলেন, “আমি দেখেছি, কোনও কোনও কারখানায় ২৯টা পর্যন্ত ইউনিয়ন! কোথাও তারও বেশি (যেমন বিড়লাপুর জুটমিলে ৪৩টি)। সিটু, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি ইত্যাদি তো রয়েছেই। কিন্তু যে সব সংগঠনের সঙ্গে শ্রমিকেরা নেই, তারাও রেজিস্টার্ড হওয়ার সুবাদে শ্রমিক স্বার্থ, কিংবা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে মতামত জাহির করে! শুধু তা-ই নয়, সেই মতামত গ্রহণ করতে চাপও দেয়!”
এমনটা চলতে থাকলে আদতে শ্রমিক স্বার্থই ক্ষুণ্ণ হবে বলে সরকার মনে করছে। আর তাই এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর উদ্যোগ। শ্রমমন্ত্রী চাইছেন, ১৯২৬-এর কেন্দ্রীয় শ্রম আইনের ২৩ থেকে ২৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী ইউনিয়নগুলির সংযুক্তিকরণ ঘটুক। এ জন্য রাজ্য আইন বা দমনমূলক নির্দেশ জারির পক্ষপাতী নয়। মন্ত্রীর আশা, শ্রমিকেরা নিজেরাই এই সংযুক্তির উদ্যোগ নেবেন।
পাশাপাশি শ্রম দফতরের রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কাজকর্মেও পরিবর্তন আনতে চাইছে সরকার। ওখানে বহু দিন ধরে ‘অশুভ চক্রের’ মৌরসিপাট্টা চলছিল বলে ইঙ্গিত দিয়ে পূর্ণেন্দুবাবু এ দিন বলেন, “সরকারি বদলির আইন মেনেই রেজিস্ট্রেশন বিভাগে অধিকাংশ নতুন কর্মী আনিয়েছি।” শ্রমমন্ত্রীর বক্তব্য, “ইউনিয়নের নাম রেজিস্ট্রেশনের সময়ে সদস্যসংখ্যার ভুয়ো ও ফাঁপানো তালিকা দেওয়া হত। তাতেই সরকারি সিলমোহর মেরে দেওয়ার চল ছিল। সেই সব তথ্য যাচাই বা স্পট ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়। ফলে এক-একটা কারখানায় তো মোট শ্রমিকসংখ্যার তুলনায় ইউনিয়নগুলোর মিলিত সদস্যসংখ্যা বহুগুণ বেশি হয়ে যেত।” এ সব দেখেই শ্রমিক সংগঠনের সদস্যসংখ্যা যাচাই করার প্রথা ফের চালু হয়েছে। ইউনিয়নগুলোকে আয়-ব্যয়, চাঁদার হিসেব ইত্যাদি সমেত আয়কর ‘রিটার্ন’ও সরকারকে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপ নিয়ে শ্রমিক নেতাদের কী মনোভাব? আইএনটিইউসি-র রাজ্য নেতা গণেশ সরকার জানান, ইউনিয়নের সংখ্যা হ্রাসের উদ্যোগে তাঁদের সমর্থন আছে। “তবে মন্ত্রী এগোনোর আগে কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলে ব্যাপারটা সহজ হবে।” বলেন তিনি। এআইটিইউসি’র দেবাশিস দত্তের কথায়, “একটা শিল্পে একটাই ইউনিয়ন থাকুক, এ আমাদের পুরনো দাবি। বহু ইউনিয়ন থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই মালিক তার সুবিধা নেন। কেন্দ্রীয় ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে যেটি যেখানে সক্রিয়, শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তাকেই দেওয়া উচিত।” |