মাইকেল শুমাখার থেকে সেবাস্তিয়ান ভেটেল- বুদ্ধ সার্কিটে তাবড় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ‘লাল কার্ড’ দেখানোর অধিকার থাকছে এক বাঙালির!
ফুটবল বা ক্রিকেট হলে তাঁকে রেফারি বা আম্পায়ার বলতে হত। ফর্মুলা ওয়ানে সেই দায়িত্বটায় থাকেন মার্শালরা। আর ভারতের ঐতিহাসিক রেসে এই মার্শালের ভূমিকাতেই থাকছেন কলকাতার দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়। এ বছরের ইন্দো-ভুটান র্যালি তৃতীয় স্থানাধিকারী এখন সরকারি ভাবে ফর্মুলা ওয়ানের প্রথম বাঙালি ‘ম্যাচ অফিশিয়াল’।
ভাবলে কেমন অনুভূতি হচ্ছে? বিজয়ীর হাসির সঙ্গে মুঠো করা দু’হাতের বুড়ো আঙুল তুলে ধরে ঝাঁকালেন বাগুইআটির বাসিন্দা। তার পর বললেন, “দুর্দান্ত!”
হাল্কা সবুজ শার্ট আর কালো ট্রাউজার্সে ঝকঝকে, নির্মেদ, বাহান্ন বছরের যুবক। যিনি আলাপচারিতার শুরুতেই বলে দিয়েছেন, “আমাকে প্লিজ ‘জন’ বলবেন। সবাই ওই নামেই চেনে।” মাঝারি উচ্চতা, ফর্সা, টিকোলো নাকের তলায় ঠোঁটের চওড়া হাসিটা পর্দানসিন হয় খুব কম। কাগজের পুরুষ্টু তাড়া বের করে দেখিয়ে বললেন, “বিরাট দায়িত্ব। নিয়মকানুন সব নিখুঁত ভাবে জানতে রীতিমতো পড়াশোনা করতে হচ্ছে রাত জেগে।” বুদ্ধ সার্কিটের ৫.১৪ কিলোমিটার ট্র্যাক বেশ কয়েকটা মার্শাল পোস্টে ভাগ করা হয়েছে। একটা পোস্টের প্রধান জন। হাতে লাল-কার্ড না থাকলেও কোনও চালক বা দলকে রেস থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকছে যাঁর। “আমাদের পোস্টে রেস পরিচালনার সব দায়িত্ব আমাদের। দুর্ঘটনা হলে হাসপাতালে পাঠানো থেকে নিয়ম ভাঙলে শাস্তি দেওয়া, সব।” বিশ্বের অন্যতম দ্রুত আর চওড়া বুদ্ধ সার্কিটে ওভারটেকিংয়ের সুযোগ বেশি। তাতে রেসের আকর্ষণ যেমন বাড়বে, তেমনি দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বাড়বে। ফলে মার্শালদের কাজটা এখানে আরও কঠিন বলে মনে করছেন জন।
|
দেবদত্ত: রেসের মার্শাল |
কলকাতার রাস্তায় হলুদ রঙের ‘ফর্মুলা ওয়ান অফিশিয়াল’ স্টিকারে সাজানো ফোর্ড সিয়েরা গাড়ি দেখলে বুঝতে হবে ওটা জনের। ভারতীয় রেসের দায়িত্বে থাকা ৪০০ মার্শালের ২৯০ জন ভারতীয়। বাঙালি শুধু জন। সেন্ট জেভিয়ার্সের বাণিজ্য বিভাগের স্নাতকের কথায়, “এক সময় জীবনটা পুরো উদ্দেশ্যবিহীন ছিল।” কিন্তু বড় কিছু করার জেদটা ছিল চিরকালই। রুজির সন্ধানে জব্বলপুরে কিছু দিন কাটিয়ে ফিরে আসেন কলকাতা। ট্র্যাফিক সিগন্যাল তৈরি করতেন এক সময়। এখন অসম আর দার্জিলিঙে চা-বাগানের মালিক, রয়েছে নির্মাণ ব্যবসা। তবে গাড়ি আর গতির নেশাটা পুরনো। মার্শাল হওয়ার সুযোগটা কী ভাবে এল জানাতে গিয়ে বলছিলেন, “র্যালি করার সুবাদে প্রথমে ই-মেলে পেয়ে আবেদন করি। চণ্ডীগড়ে নির্বাচন হয়। তার পর সেপ্টেম্বরের ৭-৮ তারিখ নয়ডায় প্রথম ট্রেনিং।” বাহরিন থেকে চিফ মার্শালরা এসে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ট্র্যাকে ফর্মুলা মারুতি গাড়ি নামিয়ে হাতে-কলমে শিক্ষার সঙ্গে ভিডিও সিমুলেশনে দুর্ঘটনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করা থেকে আরও নানা খুঁটিনাটি। চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের জন্য নয়ডা যাচ্ছেন শনিবার। কলকাতা ফিরবেন পঁচিশ তারিখ। আবার যাবেন রেসের জন্য।
মজার কথা, জনকে কিন্তু রেসিং আর র্যালির দুনিয়ায় এনেছে একমাত্র ছেলে তথাগত। দার্জিলিংয়ের নর্থ পয়েন্টের নবম শ্রেণির পড়ুয়া চেন্নাইয়ে মারুতি ফর্মুলা রেসিংয়ে নেমে ষষ্ঠ হয়েছে। ধ্যানজ্ঞান স্রেফ গাড়ি। মাত্র সাত বছর বয়সে তথাগত বাগুইআটির রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে সাড়া ফেলেছিল। উদ্বুদ্ধ হন বাবা। ঠিক করেন ছেলে ফর্মুলা ওয়ান চালক হবে। “যে রাস্তায় ওকে পাঠাব সেটা তো নিজেকে আগে চিনতে হবে।” চিনতে গিয়েই র্যালিতে নামা শুরু বছর তিনেক আগে। ফর্মুলা ওয়ান নিয়ে গবেষণাও চলছে। ঘুরে এসেছেন ইতালি, স্পেন, সিঙ্গাপুর সার্কিট। আর বুঝেছেন স্বপ্নকে বাস্তবের ফ্রেমে বন্দি করতে প্রচুর লগ্নি চাই। “অন্তত একশো কোটি লাগবে, কিন্তু ওটা কোনও টাকাই নয়।”
জনের স্বপ্নের প্রথম ধাপ সত্যি হচ্ছে আগামী সপ্তাহে। রেস মার্শাল হিসাবে ফর্মুলা ওয়ানের অন্দরমহলটা সরেজমিনে দেখার সুযোগ তাঁর সামনে। জন বলছিলেন, “জানেন, আত্মীয়-বন্ধুরা আঁতকে উঠে বলেছিল, ছেলেকে এমন জীবনের ঝুঁকি থাকা খেলায় পাঠাবে? কিন্তু আমি মনে করি ঝুঁকি না নিলে বড় হওয়া যায় না। জীবনে থ্রিলটাই তো আসল.” চালু অপবাদ, বাঙালি ভিতু। দেবদত্তবাবু সেটাই ভুল প্রমাণ করতে নেমেছেন!
|