ভিড়ের চাপে প্রতি পদে
আটকাচ্ছিল তাঁর গাড়ি
গোড়াতেই বলে রাখা ভাল, আমি যে গদ্দাফিকে দেখেছি, ভূমধ্যসাগরের উপরে জাহাজে ভাসতে ভাসতে যাঁর সঙ্গে এক রাত আমোদ করেছি তিনি কিন্তু আজকের এই ‘হতমান’ গদ্দাফি নন। বরং ঠিক উল্টো। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুয়ম্মর গদ্দাফি তখন জনতার নয়নের মণি। অন্তত আমার চোখে দেখা অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
সালটা সম্ভবত ১৯৯৪। গদ্দাফি-জমানার পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সে দেশের সরকারি আমন্ত্রণে সস্ত্রীক ত্রিপোলি গিয়েছিলাম। আমার আমন্ত্রণ পাওয়ার কারণ, তখন আমি জেনিভায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের (আইএলও) পরিচালন বোর্ডে নির্বাচিত সদস্য। বাঙালি বলে তো বটেই, ভারতীয় হিসেবেও ওই আমন্ত্রণ পেয়ে গর্ব হয়েছিল।
নির্দিষ্ট দিনে ত্রিপোলিতে পৌঁছলাম আমরা। ওখানে তখন খুব জলাভাব। মনে আছে, পানীয় জল বলতে দেওয়া হত স্কোয়াশ বা সফ্ট ড্রিঙ্ক জাতীয় কিছু। বোতলে ভরা মিনারেল ওয়াটারও দেখিনি। শুনেছিলাম, হাজার-বারোশো কিলোমিটার লম্বা ক্যানাল কাটা হচ্ছে পানীয় জলের জন্য। এত দিনে নিশ্চয় আর সেই সমস্যা নেই।
পরের দিন মূল অনুষ্ঠান। এই ধরনের যে কোনও অনুষ্ঠানেই অভ্যাগতদের আসন নির্দিষ্ট করা থাকে। আমারও ছিল। এবং ঘটনাচক্রে আমি বসেছিলাম প্রেসিডেন্ট গদ্দাফির সঙ্গে একই সারিতে, তাঁর দু’টি চেয়ার তফাতে। গদ্দাফি এলেন। পরনে সেনাদের মতো পোশাক। হাতে ছোট্ট একটি ব্যাটন। তাঁকে ঘিরে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীরাও সামরিক পোশাকের, তবে রীতিমতো সশস্ত্র।
প্রথম দেখায় খুব স্মার্ট লেগেছিল লোকটিকে। গদ্দাফির বয়সও তো তখন আরও ১৭ বছর কম! একদম ঝকঝকে, তরতাজা। টানটান চেহারা। হনহনিয়ে হাঁটেন। কোথায় যেন
একটা অহমিকা ফুটে বেরোয়। জানি না, সেটাই হয়তো ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের সময় নিছক সাহেবি হ্যান্ডশেক নয়, আমার এবং আমার স্ত্রী-র দু’হাত ধরে করমর্দন করেছিলেন গদ্দাফি। সংক্ষিপ্ত দু’-একটি বাক্যের আলাপে তাঁর মুখে একাধিকবার উচ্চারিত হল ‘ইন্ডিয়া’, ‘নিউ দিল্লি’ ইত্যাদি শব্দ। জানালেন, তিনি ভারতকে খুব ভালবাসেন।
আসল মজার ঘটনা ঘটল তার পরে। অনুষ্ঠান একটু এগোতেই মাঝপথে হঠাৎ গদ্দাফি সকল অভ্যাগতকে ডেকে বললেন, “নাউ, লেটস্ গো”। কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে? চারপাশের সরকারি লোকজনেরাও বিশেষ কেউ তা জানেন বলে তো মনে হল না। যাই হোক, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমরা বেরোলাম। যে যার নির্দিষ্ট গাড়িতে বসতেই বিরাট কনভয় রওনা হল। গন্তব্য? তখনও অজানা।
যাওয়ার পথে বারবার গাড়ি থামাতে হচ্ছিল গদ্দাফিকে। জানি, আজকের পশ্চিমবঙ্গে মানুষের মনে তুলনাটা আসবেই। তবে আমি তার মধ্যে না-গিয়েই সাধারণ ভাবে বলছি, গদ্দাফিকে গাড়ি থামাতে হচ্ছিল স্রেফ ভিড়ের চাপে। তাঁর চলার পথে তাঁকে দেখার জন্য মানুষের ঢল। বেশির ভাগই যুবক। প্রেসিডেন্ট গদ্দাফিকে ঘিরে তাঁদের উৎসাহ ও আতিশয্যের চাপে তিনি বাধাহীন এগোতেই পারছিলেন না। বারবার গাড়ি থামিয়ে নামতে হচ্ছিল তাঁকে।
তিনি কোলাকুলি করার মতো জড়িয়ে ধরছিলেন তাঁর জন্য ছুটে আসা মানুষদের।
বেশ লম্বা পথ পেরিয়ে এ বার আমরা পৌঁছে গেলাম ত্রিপোলি বন্দরে। সেখানে তৈরি ছিল বিলাসবহুল জাহাজ। সেই জাহাজে চলল উৎসবের বাকি পর্যায়। রাতভর খাওয়াদাওয়া, নাচ-গান। বুঝলাম, উৎসবের শেষটা যে ভূমধ্যসাগরের বুকে জাহাজের মধ্যে হবে, সেটা গদ্দাফি বোধহয় খুব বেশি লোককে জানাননি। হতে পারে, এটা তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থার অঙ্গ। জাহাজ থেকেও দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাদের দু’পাশে আরও দু’টি জাহাজ চলেছে পাহারা দেওয়ার জন্য।
ভোরবেলা আবার ফিরে আসা ওই বন্দরে। আনুষ্ঠানিক বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট গদ্দাফি চলে গেলেন। আর দেখা হয়নি কোনও দিন। তার অবকাশও ছিল না।
তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আপাতত ওই স্মৃতিটাই এক বার ঝালিয়ে নিলাম। ব্যক্তি গদ্দাফির স্মৃতিতে এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্য।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.