বন্দুকের সামনেই হার মানলেন একনায়ক
ন্মসূত্রে বেদুইন। অথচ জীবনযাপন ছিল তুমুল বিলাসী। তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে যতটা চর্চা হয়েছে, ‘লাস্যময়ী ইউক্রেনীয় নার্স’কে নিয়েও ততটাই। রাজধানী-ছাড়া হয়েছিলেন মাস দু’য়েক আগে। তা-ও নতি স্বীকার করেননি। ‘সত্যিকার লিবীয়রা আগ্রাসন এবং সাম্রাজ্যবাদ কখনও মানবে না’ বলে গর্জন করেছেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিজের দেশের বিদ্রোহীদের কাছে ‘হার’ মানতেই হল ‘আফ্রিকার রাজাদের রাজা’কে। নিজের জন্ম শহর সির্তেতে।
কর্নেল মুয়ম্মর গদ্দাফি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে, রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে। তার পর টানা ৪২ বছর লিবিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি। বিশ্বের অন্য কোনও রাজনৈতিক নেতার এই কৃতিত্ব নেই।
১৯৪২-এ জন্ম। বেনগাজির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল নিয়ে পড়তে ঢুকেছিলেন। কিন্তু পড়া শেষ না করেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। দেশের মানুষের কাছে নায়ক হওয়ার স্বপ্নটা মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিল আগেই, সেনাবাহিনীতে থাকতে থাকতেই। কিন্তু রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতায় আসার পরে বিপ্লবী নায়কের তকমাটা সরিয়ে ফেলতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। নিজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে নিয়ে শুরু করেছিলেন দেশ পরিচালনা। ১৯৭৭ সালে নিজেই দেশের নাম পাল্টে ফেলেন। তাঁর দেশ লিবিয়া ছিল ‘জনগণের রাষ্ট্র’। অথচ তাঁর নিজের দেশের মানুষেরই প্রতিবাদ দেখানোর রাস্তা ছিল বন্ধ। তিনি আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। নিজের ‘গ্রিন বুক’-এ গদ্দাফি লিখেছেন, গণতন্ত্র একটি ‘বিশাল ক্ষমতাশালী দলের একনায়কতন্ত্র’। সত্তরের দশকেই এক দল পড়ুয়ার প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছিলেন গদ্দাফি। তাঁদের অপরাধ? নিজেদের অধিকার চেয়ে বেনগাজি আর ত্রিপোলিতে মিছিল আর বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা। লিবিয়ার গদ্দাফি বিরোধী আন্দোলনের এক নেতা একটি আরবি চ্যানেলকে জানিয়েছিলেন, বেনগাজির আবু সালিম জেলে এক বার তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১২০০ নিরস্ত্র বন্দিকে মেরে ফেলেছিলেন গদ্দাফি। ওই নেতার কথায়, “নিজের প্রয়োজনে কসাইয়ের ভূমিকা পালন করতেও পিছপা হতেন না লিবিয়ার এই ‘একনায়ক’।”
গদ্দাফি নিজেকে ‘রাজনৈতিক দার্শনিক’ হিসেবে দেখতে ভালবাসতেন। বলতেন, ‘দেশের সব লোক আমাকে ভালবাসে।’ সবাই না হোক, দেশের মানুষের একটা বড় অংশের সমর্থন তাঁর পাশে দীর্ঘদিন ছিল। তা না হলে ৪২ বছর ধরে শাসন ক্ষমতায় থাকা যায় না বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমর্থনে অবশ্যই ক্ষয় ধরেছে। যার পরিণতি এই বিদ্রোহ। গদ্দাফিকে ‘স্বৈরাচারী একনায়ক’ আখ্যা দায়ে যে বিদ্রোহে মদত জুগিয়েছেন পশ্চিমী দুনিয়া। অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রফতানির যাবতীয় মুনাফা নিজের ও পরিবারের কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন গদ্দাফি। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় তাঁর নায়ক ছিলেন মিশরের সামরিক নেতা জেনারেল আবদেল নাসের। সেই নাসেরের সঙ্গে তুলনা টেনেই নিন্দুকেরা বলতেন, ‘‘মিশরে নাসেরের লক্ষ্য ছিল সুয়েজ খাল আর কর্নেল গদ্দাফির লক্ষ্য, তাঁর দেশের তেলের ভাণ্ডার।” অথচ আফ্রিকার দেশগুলিকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে এক সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। মূলত গদ্দাফির উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’।
তাঁর নিজের দেশের লোকজনই তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ আখ্যা দিয়েছিল। যদিও বিশ্বের বাকি অংশে নিজেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা হিসেবে তুলে ধরতে কসুর করেননি কর্নেল গদ্দাফি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের কাছে নায়কও ছিলেন এই কারণে। আর সাম্রাজ্যবাদ এবং পশ্চিমী দুনিয়ার বিরোধিতা ফলাও করে দেখাতে গিয়ে আক্রমণের পথ নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। ১৯৮৬ সালে বার্লিনের এক পানশালায় বিস্ফোরণে গদ্দাফির হাত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। ওই বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন দুই মার্কিন সেনা। বলা হয়, বার্লিন বিস্ফোরণের বদলা নিতেই ত্রিপোলি আক্রমণ করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন। তাতে প্রাণ যায় ৩৫ জনের। নিহত হন গদ্দফির এক দত্তক মেয়েও। কিন্তু তা-ও দমাতে পারেনি রেগনের কথায় এই ‘ম্যাড ডগ অফ মিডল ইস্ট’কে। মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, এক সময় রেগনকেও মারার চক্রান্ত করেছিলেন গদ্দাফি।
এর ঠিক দু’বছর পরে, ১৯৮৮ সালে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে স্কটল্যান্ডের লকারবিতে মাঝ আকাশে ভেঙে পড়ে প্যান-অ্যাম ফ্লাইট ১০৩। বিমানে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। মারা যান ২৭০ জন। এর পিছনেও গদ্দাফির হাত ছিল বলে অভিযোগ। প্রথমে গদ্দাফি তা স্বীকার করতে চাননি। এর পরই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞা জারি হয় লিবিয়ার উপর। ১৯৯৯ সালে দায় স্বীকার করে লিবিয়া। দু’জন লিবীয়কে স্কটল্যান্ড পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হয় গদ্দাফি সরকার। তার পরেই ওঠে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
২০০৩-এ লিবিয়ার যাবতীয় গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংস করে ফেলেন গদ্দাফি। তার পর থেকেই পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে লিবিয়ার। পরের বছর লিবিয়ার উপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ।
তাঁবুতে জন্মেছিলেন। নিজের বেদুইন জীবনকে মনে রেখেই হয়তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিলাসবহুল তাঁবু নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন গদ্দাফি। আর ওই তাঁবুতে তাঁকে ‘সঙ্গ’ দিতেন তাঁর মহিলা দেহরক্ষীরা। তাঁকে নিয়ে একাধিক গল্প ফাঁস হয়েছে মার্কিন কেব্ল বার্তায়। তিনি নাকি উঁচুতে চড়তে ভয় পেতেন। এক টানা আট ঘণ্টার বেশি আকাশ ভ্রমণও ছিল তাঁর অত্যন্ত না-পসন্দ। ২০০৯ সালে নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন লিবিয়ার এই শাসক। সেখানকার হোটেলে ৩৫টার বেশি সিঁড়ি চড়তে অস্বীকার করেছিলেন গদ্দাফি। তাঁর জন্য একতলায় আলাদা ঘরের বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল। দশ মিনিটের বরাদ্দ করা সময়ে টানা পৌনে দু’ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জে। আবার সেই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে ‘সন্ত্রাসের’ পরিষদ বলতে দ্বিধা করেননি তিনি।
এ বছর অগস্টের শেষে ত্রিপোলি যখন বিদ্রোহীদের দখলে এল, পালিয়ে গিয়েছিলেন লিবিয়ার ‘ব্রাদার লিডার’।
কোথায় গদ্দাফি? সারা বিশ্বের তখন প্রশ্ন একটাই। তার পর থেকেই তাঁর দেশ ছাড়া নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়েছে। গুজব ছড়িয়েছে তাঁর মৃত্যু নিয়েও। কিন্তু মাঝে মধ্যেই শোনা যেত তাঁর রেডিও বার্তা। যেখানে তিনি খালি বলতেন, “আমি আমার দেশ ছেড়ে পালাব না। এখানেই শহিদের মতো জীবন দেব। আমাকে এখান থেকে কেউ হঠাতে পারবে না।” কিন্তু সেই আস্ফালন শেষ পর্যন্ত থামল বন্দুকের নলের সামনে। আর মৃত্যুর আগে সম্ভবত প্রথম বারের জন্য একনায়কের ঔদ্ধত্য সরিয়ে আর্তি ফুটল গদ্দাফির গলায়, “আমাকে গুলি কোরো না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.