শিল্পপতিদের সঙ্গে বিজয়া সম্মেলন করলেই রাজ্যে শিল্পায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। তাঁর বক্তব্য, জমির প্রশ্ন সরিয়ে রেখে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে শিল্পায়ন সম্ভব নয়। শিল্প করতে গেলে তার জন্য জমি কোথা থেকে আসবে, সে কথা আগে ভাবতেই হবে।
ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নতুন জমি-নীতি ঘোষণা করেছেন, তাতে শিল্পের জন্য জমি কেনার দায়িত্ব শিল্পপতিদেরই দেওয়া হয়েছে। ফলে জমি অধিগ্রহণের ঝক্কি সয়ে কত জন শিল্পপতি রাজ্যে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আজই কলকাতায় রাজ্যের প্রথম সারির শিল্পকর্তাদের মুখোমুখি হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। সরকারি ভাবে একে ‘বিজয়া ও দীপাবলি উপলক্ষে সৌজন্যমূলক সমাবেশ’ বলা হয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আসল উদ্দেশ্য শিল্পমহলের কাছে এই বার্তা দেওয়া যে তিনি শিল্প-বিরোধী নন।
 কলকাতায় মমতা যে দিন নিজেকে ‘শিল্পবন্ধু’ হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট, ঠিক সেই দিনই দিল্লিতে সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠকে যোগ দিতে এসে মমতার শিল্পায়নের প্রচেষ্টা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন নিরুপম সেন। তাঁর বক্তব্য, তিনি নিজে কোনও দিন এই পথে হাঁটার প্রয়োজন বোধ করেননি। নিরুপম বলেন, “বিজয়া সম্মেলন একটা সামাজিক অনুষ্ঠান। সেখানে যে কেউ যে কাউকে আমন্ত্রণ জানাতেই পারেন। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি যখন শিল্পমন্ত্রী ছিলাম, তখন এটাকে শিল্পায়নের পথ বলে মনে করিনি।”
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় নিরুপম সেন শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীনই সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা ও নন্দীগ্রামে পেট্রোরসায়ন তালুক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর ওই দু’টি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনকে হাতিয়ার করেই রাজ্য রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু শিল্প নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোভাব নিয়েই শিল্পমহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে বারবার বলা হয়েছে, সিপিএমের তরফেই শিল্প ও বাণিজ্য মহলকে ভ্রান্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও শিল্প প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমি-নীতির সমালোচনা করছেন নিরুপমবাবুরা। সিপিএমের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের ফলে জমির মালিকানার চরিত্র বদলে গিয়েছে। আগে যে জমি এক জন কৃষকের মালিকানাধীন ছিল, এখন সেই জমিই টুকরো টুকরো হয়ে বহু কৃষকদের হাতে চলে গিয়েছে। বড় শিল্পের জন্য বড় আয়তনের জমি প্রয়োজন হবেই। সে ক্ষেত্রে শিল্পপতিদের পক্ষে সব কৃষককে রাজি করিয়ে জমি কেনা সম্ভব নয়। বিশেষত যে শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, সেই প্রকল্পকে জনস্বার্থমূলক ধরে নিয়ে সরকার তার জন্য জমি অধিগ্রহণ করতেই পারে।
বস্তুত এই যুক্তিতে ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে হারের পরেও শিল্পায়নের পথ থেকে নীতিগত ভাবে সরে আসতে চাননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনরা। তাঁদের যুক্তি ছিল, ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা এবং কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যের পর শিল্পায়নের পথে না গেলে রাজ্যের অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়ত। আর শিল্পায়ন করতে গিয়ে কুটির শিল্প বা ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি বড় শিল্পও দরকার হবে। সেই বড় শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণেরও প্রয়োজন পড়বে। সেই সূত্র ধরেই রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী আজও বলেন, “জমির বিষয়টিকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কখনওই শিল্পায়ন সম্ভব নয়।” |