প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনের মঞ্চ থেকে দলকে পুনর্গঠনের ডাক দিলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র। একই সঙ্গে ‘প্রত্যয়ী’ কণ্ঠে বললেন, মতাদর্শগত বিচ্যুতি কাটিয়ে, সাংগঠনিক ত্রুটি শুধরে দল আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।
এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার ৯২ তম বার্ষিকী পালনের অনুষ্ঠানে এ বার বক্তা ছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু। সচরাচর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকই প্রতিষ্ঠা দিবসে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করে থাকেন। এ বার বিমান বসু দলের পলিটব্যুরো বৈঠক উপলক্ষে দিল্লিতে থাকায় দায়িত্ব পালন করলেন সূর্যবাবু। তবে সোমবার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে সূর্যবাবু যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক হিসাবে রঘুনাথ কুশারী ছাড়া সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আর কোনও সদস্যকে সেখানে দেখা যায়নি। পলিটব্যুরোয় না-গিয়ে কলকাতায় থাকলেও এ দিনের আসরে ছিলেন না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
জন্মলগ্ন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিকে নানা আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে বলে উল্লেখ করেও সূর্যবাবু ব্যাখ্যা করেন, এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দলকে যেতে হচ্ছে, তার ‘গুণগত মান’ অন্য রকম। এমন সময়ে তাঁদের উপরে আক্রমণ নেমে এসেছে, যখন পরিস্থিতির ‘ভারসাম্য’ সিপিএমের অনুকূলে নয়। জনসমর্থন কমেছে। তবু ৩৪ বছর একটি বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও বামফ্রন্টের গত বিধানসভা ভোটে ৪১% সমর্থন পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-এই ‘বাস্তবে’র উপরে ভরসায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। স্বভাবতই এসেছে বিপর্যয়ের প্রসঙ্গও।এবং সেই সূত্রেই সূর্যবাবু বলেছেন, “বাইরের কারণগুলি কখনও বড় কারণ হয় না। অভ্যন্তরীণ কারণ থাকে। সেই কারণগুলিকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংগঠনিক নানা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে পাখির চোখ হিসাবে দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে হবে সাংগঠনিক দিকেই। দলটাকে পুনগর্ঠিত করতে হবে। দলকে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযুক্ত করে গড় তুলতে হবে।”
বাইরের পরিস্থিতি বা ‘বস্তুগত উপকরণ’ এবং দলের অভ্যন্তরের ‘মনোগত উপাদানে’র সংমিশ্রণেই যে কমিউনিস্ট পার্টির পুনরুত্থানের রাস্তা তৈরি করতে হবে, অতীত এবং বর্তমানের নানা দৃষ্টান্ত টেনে তা ব্যাখ্যা করেছেন সূর্যবাবু। মাও জে দঙের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, “মুরগি তা দিয়ে ডিম ফুটিয়ে ছানা বার করে। তাই বলে পাথরে বসে সারা দিন তা দিলে বাচ্চা বেরোবে না! তার জন্য ডিমের ভিতরে বাচ্চা জন্মানোর মতো উপাদান থাকতে হবে।” অর্থাৎ পরিস্থিতির মধ্যে ‘অনুকূল’ দিকগুলি খুঁজে বার করার কথা বলেন বিরোধী দলনেতা। তিনি নিজেই জানান, পরিপার্শ্বের অবস্থায় নানা ‘অনুকূল’ দিক আছে। কিন্তু একই সঙ্গে বলেন, শুধু প্রচার করলেই মানুষ তাঁদের কথা বুঝে ফেলবেন না। প্রচার করেও সাম্প্রতিক দু’টি উপনির্বাচনে তাঁরা কিছু করতে পারেননি। মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়েই পরিস্থিতি বুঝে নেবেন।
পরিপার্শ্বিকের এমন ব্যাখ্যা দিয়েই সূর্যবাবু আবার দলীয় কর্মীদের সতর্ক করেন, “তার মানে কেউ যদি মনে করেন, এখন দেড়-দু’বছর ঘুমোলেই চলবে, তা হলে ভুল হবে! কবে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের লাগবে, কবে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের বিবাদ হবে, কবে পাহাড়ের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তৃণমূলের সংঘাত হবে, কবে এর সঙ্গে তার লাগবে, তখন জেগে উঠলেই চলবে এই ভেবে বসে থাকলে চলবে না! স্বতঃস্ফূর্ততার উপরে ভরসা করে বসে থাকা যায় না। সব চেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও সম্ভাবনা খুঁজতে হবে।” পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের ব্যাখ্যা যখন মানুষকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না, সেই সময়টাকে সংগঠন মেরামত এবং মতাদর্শগত চর্চা ও তার প্রয়োগের জন্য কাজে লাগানোর পক্ষেই সওয়াল করেছেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সূর্যবাবু। |