‘অনিলায়ন’ ভাঙছেন মমতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি রুখতে নয়া বিধি
রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে রাজনীতি-মুক্ত করতে আইন সংশোধন করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সোমবার প্রেসিডেন্সি বাদে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংশ্লিষ্ট আইন বদলের জন্য অর্ডিন্যান্সে সই করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অর্ডিন্যান্স পেশ করা হবে। তার পর তা যাবে রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য। নয়া অর্ডিন্যান্স বলবৎ হলে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ ঐতিহ্যে ইতি পড়বে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের বিশ্বাস।
সাড়ে তিন দশকের বাম জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে মানের ক্রমিক অবনতির যে অভিযোগ, তার মূলেই রয়েছে রাজনীতির অনুপ্রবেশ। সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের হাত ধরে সেই দলতন্ত্রের সূত্রপাত। যা শিক্ষার ‘অনিলায়ন’ নামে পরিচিত। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে অনিলবাবুর হাতিয়ার ছিল তাদের পরিচালন সমিতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যা সেনেট-সিন্ডিকেট, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্ট। বিধি বলে এই সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটির অর্ধেকের বেশি সদস্য হয় শিক্ষাকর্মী, না-হয় ছাত্র-ছাত্রী, না-হয় রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট কেন্দ্রের ভোটে জিতে আসা ব্যক্তি। বাম আমলের বেশির ভাগ সময় জুড়ে যাঁরা ছিলেন শাসক দলের সমর্থক।
শিক্ষাকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তি কেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবেন বা উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে মত দেবেন, সেই প্রশ্ন অতীতে বহু বার উঠেছে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমালোচনায় কান দেয়নি সিপিএম। পরিচালন সমিতিতে সমর্থক প্রতিনিধিদের সংখ্যাধিক্যের জোরে উপাচার্য থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে অনিলবাবু ‘নিজের লোক’ বসাতেন, এমন অভিযোগও ছিল শিক্ষা মহলের। বস্তুত, বাম আমলেই ঘটনাচক্রে আলিমুদ্দিনের পছন্দের উপাচার্য না পেয়ে ছাত্র ও কর্মচারী সংগঠনকে দিয়ে দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে রাখার দৃশ্যের সাক্ষী কলকাতা শহর। ক্ষমতায় এসে এ বার সেই অবস্থা বদলাতে চাইছেন মমতা। উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনগত যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে চান তিনি।
সেই লক্ষ্যে রাজ্যের ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রেসিডেন্সির জন্য পৃথক অর্ডিন্যান্স আনা হবে মাসখানেকের মধ্যেই) আইন সংশোধন করে যে অর্ডিন্যান্স আনা হচ্ছে, তাতে সেনেট, সিন্ডিকেট বা কোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিতে কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকতে পারবেন না। এমনকী, সদস্য হতে পারবেন না ছাত্র, ছাত্রনেতা বা শিক্ষাকর্মীরাও। এত দিন বিধানসভার অধ্যক্ষের পছন্দসই বিধায়ক পরিচালন সমিতির সদস্য হতেন। থাকতেন সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মনোনীত সদস্যও। নয়া আইনে সেই ব্যবস্থারও বিলোপ ঘটতে চলেছে। অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিতে থাকবেন শুধু শিক্ষাব্রতীরা। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষাবিদ ছাড়া অন্য কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই মনোনীত সদস্য হতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি উপাচার্যদের উপরেও নজর রাখবে রাজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির বাইরে উপাচার্যের কোনও কার্যক্রম থাক, তা মমতার সরকার চায় না। তাদের বক্তব্য, ছাত্রস্বার্থ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নেই উপাচার্য একনিষ্ঠ থাকুন। সেই কারণে উপাচার্যের কোনও রকম রাজনৈতিক পরিচয় পেলে তৎক্ষণাৎ তাঁকে অপসারণ করার কথা অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে। মহাকরণ সূত্রে খবর, চার বছরের কার্যকালের মধ্যে যে কোনও সময় উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোনও রকম দুর্নীতি বা চারিত্রিক অভব্যতা বা রাজনৈতিক মদত বা কোনও রাজনৈতিক পরিচিতির অভিযোগ উঠলে, তা খতিয়ে দেখতে ভিজিল্যান্স কমিশন গড়বে উচ্চশিক্ষা দফতর। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দ্রুত সেই উপাচার্যকে অপসারিত করা হবে। উল্লেখ্য, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান আইনে উপাচার্যদের অপসারণ করার কোনও সংস্থান ছিল না।
উপাচার্য খোঁজার দায়িত্বও পরিচালন সমিতির কাছ থেকে নিয়ে সার্চ কমিটির হাতে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই নিয়োগ করা হবে তিন সদস্যের সার্চ কমিটির মাধ্যমে। এই সার্চ কমিটিতেও কোনও রাজনৈতিক দল বা সরকার মনোনীত প্রতিনিধি থাকবেন না। আচার্য মনোনীত প্রতিনিধির পাশাপাশি থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এবং অন্য কোনও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি। সার্চ কমিটি গড়ার কারণ হিসেবে মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, অন্য অনেক রাজ্যেই উপাচার্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইউজিসি-র একটা ভূমিকা থাকে। সর্বভারতীয় সেই ধারার সঙ্গে এ বার একাত্ম হতে চাইছে এ রাজ্যও। এর ফলে একই সঙ্গে স্বজনপোষণের অভিযোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে। বাম আমলে যে অভিযোগ জড়িয়ে থাকত উপাচার্য বাছাইয়ের পরতে পরতে।
এ রাজ্য থেকেই উপাচার্য খোঁজার যে চল এত দিন ছিল, সেই ধারাও ভাঙতে চলেছে নতুন সরকার। আঞ্চলিকতাবাদের দুর্নাম ঘোচাতে রাজ্যের বাইরের এমনকী, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদেরও এ রাজ্যে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। দলীয় আনুগত্য মেনে অনেক সময়ই অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ করার অভিযোগ উঠেছে বিগত বাম সরকারের আমলে। সেই বদনাম ঘোচাতেই এ বার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আইনে এমন রদবদল ঘটতে চলেছে বলে মহাকরণ সূত্রে খবর। সোমবার এই অর্ডিন্যান্সের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “যত ক্ষণ না রাজ্যপাল এই অর্ডিন্যান্সের ব্যাপারে সম্মতি দিচ্ছেন, তত ক্ষণ এ প্রসঙ্গে আমার পক্ষে কিছু বলা সমীচীন নয়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.