স্টিভ ডার্বির এ ভাবে মোহনবাগানের কোচিং ছেড়ে যাওয়াটা দুঃখের। কারণ ভদ্রলোক কিছু না বুঝেই, টেকনিক্যাল কমিটির ওপর সব দোষ চাপিয়ে চলে গেলেন। আমি এটা চাইনি। মোহনবাগানের এখন খারাপ সময় চলছে। অনেক দিন ট্রফি নেই। জীবনে প্রথম বার তাই প্রকাশ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলাম। কারও সঙ্গে সংঘাত বা খবরদারি করার কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না। সে জন্যই দায়িত্ব নেওয়ার আগে ক্লাবকর্তাদের বলেছিলাম, আমাদের তিন জন অর্থাৎ আমি, প্রশান্ত আর সত্যজিৎকে ওর সঙ্গে বসিয়ে দিন। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। ফলে সম্পূর্ণ ভুল বুঝে ডার্বি ক্লাবই ছেড়ে দিল। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে। জানি না ওঁর সঙ্গে কখনও দেখা হবে কি না। তবে দেখা হলে ডার্বিকে বলব, “সাহেব, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনাকে তাড়ানোর বা চাপ সৃষ্টি করার কোনও ইচ্ছা আমাদের ছিল না।”
শুনেছি ডার্বির ফুটবল অভিজ্ঞতা অনেক। তাই তাঁর নিশ্চয়ই জানা উচিত, সারা বিশ্বেই টেকনিক্যাল কমিটির ধাঁচে কোচকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ক্লাবগুলোতে কমিটি থাকে। মূলত তাদের কাজ হচ্ছে কর্তা এবং কোচের মধ্যে সেতুবন্ধন করা। কোচকে নানা পরামর্শ দেওয়া। বায়ার্ন মিউনিখে রুমেনিগে, রিয়াল মাদ্রিদে জিদান, প্যারিস সা জা-এ লিওনার্দোরা এই কাজটাই করে। আমি চেয়েছিলাম সে রকমই করতে। কোচ হচ্ছেন একটা টিমের সুপার বস। তিনিই সর্বেসর্বা। তাঁকে সাহায্য করার জন্য সাপোর্টিং স্টাফ থাকে। মোহনবাগানে যেমন এ বার বার্নার্ড ওপারানোজি, হেমন্ত ডোরা, জোনাথন কর্নাররা আছে। মোহনবাগানে যে টেকনিক্যাল কমিটি তৈরি হয়েছে সেটা আসলে টেকনিক্যাল সাপোর্টিং টিম। যাদের কাজ কোচকে পরামর্শ দেওয়া। সেটাই তো দিতে চেয়েছিলাম ডার্বিকে। যদি উনি মানতেন, ভাল। যদি উনি বলতেন, আপনাদের দরকার নেই, তা হলে বিশ্বাস করুন, সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করে চলে যেতাম।
ডার্বির সঙ্গে আমাদের ক্লাবের মাঠে একবার দেখা হয়েছিল। ফুটবল নিয়ে কথা হয়নি। ওর গার্লফ্রেন্ড, বিয়েএ সব নিয়ে টুকটাক কথা হয়েছিল। দেখে মনে হয়েছিল, লোকটা খুব নরম ধাঁচের। পরে ফেড কাপে মোহনবাগানের খেলা দেখে বুঝলাম, ডার্বি যত বড় কোচই হোন, ভারতে আসার আগে এখানকার ফুটবল সম্পর্কে কোনও ধারণা নিয়ে আসেননি। বিদেশে পেশাদার ফুটবলাররা নিজেদের ফিটনেস ঠিক রাখে নিজেদের তাগিদে। এখানে একমাত্র ব্যারেটোর মধ্যে এটা দেখেছি। মোহনবাগানের অন্য কেউ অনুশীলনের বাইরেও নিজেদের ফিট রাখার জন্য পরিশ্রম করছে এ রকম দেখিনি বা শুনিনি। ডার্বি ভেবেছিলেন, বিদেশের পেশাদারদের মতো এখানেও ফুটবলাররা নিজেরাই ফিটনেস রাখবে। কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল তা ফেড কাপেই প্রমাণ হয়ে গেছে। মোহনবাগানের ফেড কাপের খেলা টিভিতে দেখে চমকে উঠেছি। মনের মধ্যে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, টিমটাকে নিয়ে দু’মাস ধরে কী করলেন কোচ-ফিজিওরা? টিমটার ফিটনেস খুব খারাপ। ২০-২৫ মিনিটের বেশি দৌড়নোর ক্ষমতা নেই কারও। সবথেকে বড় কথা, তিন ব্যাক ফর্মেশনে খেলা। যা এখানে অচল। আমি কোচ হলে সেই টিমে সুধীর কর্মকার, জার্নেল সিংহ আর অরুণ ঘোষ একসঙ্গে থাকলে তবেই তিন ব্যাকে খেলাতাম। ডার্বি থাকলে ওঁকে পরামর্শ দিতাম, ওই ভুলটা আর করবেন না। জানতে চাইতাম, ওডাফার কি চোট আছে?
আমাদের এখানকার ক্লাবে কোচিং করতে হলে রহিম সাহেব, বলাই চাটুজ্জে বা বাঘাদা-র মতো টাফ হওয়া দরকার। যারা ফুটবলারদের ‘গুঁতোবে’। চাপ দিয়ে কাজ বার করে আনবে। ডার্বির মধ্যে সেটা ছিল না। ট্রেভর মর্গ্যান বা কার্লোস পাহিরার মতো বিদেশি কোচের মধ্যে যে একটা নরমের মধ্যেও কঠিন আবরণ আছে সেটাও ডার্বির চাল-চলনে দেখিনি। যে জিনিসটার খুব দরকার ছিল টিমকে সামলাতে। আমি জানি না মোহনবাগান শেষ পর্যন্ত কাকে কোচ করবে। যেই কোচ হোক, আমি তাকে তিনটে পরামর্শ দেব। এক) টিমের ফিজিক্যাল ফিটনেস বাড়াও। দুই) টিমে এত চোট-আঘাত। দলের রিহ্যাব স্পেশ্যালিস্টকে বলো দ্রুত সবাইকে সুস্থ করতে। তিন) ফর্মেশনটা ফুটবলারদের দেখে ঠিক করো। সোমবারই আমি কমিটির অন্য দু’জনকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলাম। সকালে প্রশান্ত, সত্যজিৎ গিয়েছিল বার্নার্ডের অনুশীলন দেখতে। ওদেরও একই মত।
মাত্র একটা মাত্র টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হয়ে আমাদের ভুল বুঝে ডার্বি চলে গেলেন। তিনটে ম্যাচ একজন কোচের পারফরম্যান্সের মাপকাঠি হতে পারে না। গতবার তো মোহনবাগানের কাছে ফেড কাপে করিম বেঞ্চারিফার সালগাওকর ৬ গোল খেয়েছিল। পরে আবার করিমের দলই আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। জানি না, নতুন কোচ এসে কী করবে। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আই লিগ। যে-ই কোচ হয়ে আসুক হাতে অল্প সময় পাবে। তাকে অনেক ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। তবে কাজটা কঠিন হলেও প্রত্যাবর্তন কিন্তু অসম্ভব নয়। আমাদের পরামর্শ নিয়ে একটু বুদ্ধি করে চললে এই টিমটাই কিন্তু আই লিগ চ্যাম্পিয়নের দাবিদার হতে পারে। |