প্রবন্ধ ২...
স্বশাসনের দাবি কি শুধু উন্নয়ন দিয়ে রোখা সম্ভব
পাহাড় সুন্দর। অনাড়ম্বর, সরল তার সৌন্দর্য। কিন্তু তাতে পৌঁছনোর পথটি জটিল, বিপদসংকুল, বিশেষত সমতলের মানুষের কাছে। একটু বে-খেয়াল হলেই, বা বেশি তাড়াহুড়ো করলেই পা হড়কানোর সম্ভাবনা তাতে হিতে বিপরীত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, তাঁর রাজনীতির শৈলীকে যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে দেখে আসছেন, তাঁরা সকলেই একমত হবেন যে, ধীরে-সুস্থে নেওয়া হিসেবি পদক্ষেপে নয়, নানা সমস্যাদীর্ণ পথে অকুতোভয়, অস্থির পদচারণাতেই মেলে তাঁর রাজনীতির স্বাক্ষর, যা তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তারও একটি কারণ।
ফলে, আগ্রহ ছিল বিরোধী নেত্রী থেকে রাজ্যের প্রধান শাসকে তাঁর রূপান্তর কতটা মসৃণ হয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহ মনে হয়েছিল, তিনি যেন পথ ও প্রশাসনকে এক করে দিয়ে এক নতুন রাজনীতির উদ্বোধন করছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল, পথকে/লক্ষ্যকে তিনি ভোলেননি বটে, কিন্তু এখন তাকে প্রশাসকের চোখে দেখতে শিখেছেন। ফলে, প্রতিবাদী রাজনীতির ঝোড়ো স্রোতে ভেসে যাওয়ার বদলে, প্রশাসনিক দায়িত্বের বর্মে তিনি কুশলী কণর্র্ধারের মতো ধীরস্থির ভাবে অভীষ্ট তীরে পৌঁছতে চাইছেন। দার্জিলিং সফরে দেখলাম এমনই ভারসাম্যের পথচলা।
দার্জিলিং পাহাড় নিয়ে, (উনিশ শতকে চা বাণিজ্যের কারণে) তার ব্রিটিশ-ভারতভুক্তি এবং পরিণামে বাংলার প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তির সময় থেকে জাতীয় আন্দোলনের সময় পর্যন্ত কম বিতর্ক ছিল না। মুখ্যত চা-শিল্পের জন্য এসে, সে অঞ্চলের ভূমিপুত্র লেপচা-লিম্বুদের প্রান্তিক করে দিয়ে, নেপালি-গোর্খাদের সংখ্যা ও প্রতিপত্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে ১৯৪৭ সালে সংবিধান পরিষদে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটির পক্ষে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও জি এল সুব্বা স্বাধীন ‘গোর্খাস্তান’ গঠনের জন্য একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। স্বাধীনতার পরের তিন দশক চলে গোর্খা লিগের মোটের ওপর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ১৯৮০-র দশকে, সুবাস ঘিসিঙের জি এন এল এফ-এর প্রবল উত্থানে যা তছনছ হয়ে যায়। সূচনা হয় রাজ্য সরকার ও প্রধান শাসক দল সি পি আই এমের সঙ্গে গোর্খাদের বৈরিতার রাজনীতির। এই রক্তক্ষয়ী রাজনীতির আপাত-সমাপ্তি ঘটে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ গঠনে। ক্রমে এই পরিষদ ঘিসিঙের জায়গিরদারি ও কথিত দুর্নীতির আখড়া হয়ে দাঁড়ায়।
ধীরে ধীরে পাহাড়ে সি পি আই এম অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকে, চলতে থাকে রাজনৈতিক মোকাবিলার বদলে প্রশাসনিক স্তরে আর্থিক সুযোগসুবিধার নানা উপঢৌকন দিয়ে ঘিসিঙের সঙ্গে বোঝাপড়া কেনার কৌশল, যা ভেঙে যায় ২০০৭ সালে, জি এন এল এফের গর্ভ থেকে তৈরি হওয়া গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাপটে। ঘিসিঙের কায়দায় মোর্চার বিমল গুরুঙ্গরা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের একমাত্র দাবিদার হয়ে জি এন এল এফ-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্ষরিক অর্থে মেরে তাড়ায় এবং আন্দোলনের জঙ্গিপনা বাড়াতে পাহাড় সংলগ্ন ডুয়ার্স-তরাইয়ের প্রায় দুশো মৌজা দাবি করে। ফলে, এক দিকে পূর্বতন রাজ্য সরকার, অন্য দিকে ডুয়ার্স অঞ্চলের শতাব্দীপ্রাচীন
বাসিন্দা, মধ্য ভারত থেকে চা-শ্রমিক হিসেবে আসা মদেশিয়াদের বড় অংশের সঙ্গে বৈরিতায় জড়ায়। ঘটনাপ্রবাহ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয়, যখন এ বছরের গোড়ায় মোর্চার নেতৃত্বে গোর্খাদের মিছিল ডুয়ার্সে নেমে আসার সময় শিপচুতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়, যার জেরে তিন মোর্চা সমর্থকের মৃত্যু হয়।
এই পটভূমিতে গত বিধানসভা ভোটে, পাখির চোখের মতো সি পি আই এম বিরোধিতার লক্ষ্যে অবিচল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মোর্চার মনের তন্ত্রী আস্থার সুরে মিলেছিল। ভোটে বিপুল জয়ের পর মহাকরণে দাঁড়িয়ে রোশন গিরিকে ‘রোশনদা’ সম্বোধনে অভিভূত করে, অল্প কিছু দিনের মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য-মোর্চার ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জি টি এ গঠন করে মমতা তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অস্বস্তি খচখচ করছিল ডুয়ার্স-তরাইয়ের একাংশের জি টি এ-তে শর্তসাপেক্ষ (একটি সরকারি কমিটি ওই অঞ্চলের নানা পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে) অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবে এবং তা নিয়ে ডুয়ার্স-তরাইয়ের অধিবাসীদের আশঙ্কাজনিত ক্ষোভে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মঞ্চে হাজির থেকেও বিমল গুরুঙ্গের চুক্তিতে সই না-করার বিষয়টি। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি গুরুঙ্গ নিজে চুক্তির বাইরে থেকে গিয়ে পৃথক রাজ্যের জন্য ভবিষ্যতে আন্দোলনের পথ খোলা রাখলেন?
এই সব খচখচানি হাওয়ায় উড়িয়ে প্রশাসক মমতা অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’বার পাহাড়ে গেলেন। এক বার বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর, দ্বিতীয় বার কল্পতরু হয়ে। এ বার কখনও তিনি শ্রমিক রমণীদের সঙ্গে চা-পাতা তুলছেন, কখনও বা অভ্যর্থনায় পাওয়া খাদা গায়ে জড়িয়ে স্থানীয় দোকানে চা পান আর বিস্ময়াবিষ্ট জনতাদের চিপ্স আর বিস্কুট বিতরণ। কোথাও কোনও পুরনো/চেনা ঝাঁঝ নেই। আছে পরিতৃপ্তির ছবি। প্রশাসনিক পরিতৃপ্তি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে ভ্রমণের সময় নেহরু বা ইন্দিরার মুখে আমরা বহু বার এমনই তৃপ্তির স্মিত হাস্য দেখেছি, যেখানে দল নেই, রাজনীতি নেই, আছে প্রধান শাসক ও প্রান্তবাসীর একান্ত মেলামেশার দুর্লভ মুহূর্তগুলি।
মমতা নিশ্চয়ই নেহরু বা ইন্দিরা নন। কিন্তু এ বার দার্জিলিঙে তিনি নিঃসন্দেহে এক মনখোলা প্রশাসক, যিনি রাজনীতির ভারে ন্যুব্জ নন; কেননা দার্জিলিং অঞ্চলে তাঁর কোনও রাজনীতির বোঝা/ব্যাগেজ নেই। বিশ্বের সবচেয়ে দামি দুরবিন লাগিয়েও এখানে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও রমরমে অফিস চোখে পড়বে না। ফলে, দলীয় রাজনীতির দিক থেকে মমতা এখানে ‘স্টেক-হোল্ডার’ নন, এমনকী সি পি আই এমের মতো তাঁকে গোর্খাদের বিষয়ে বৈরিতার স্মৃতিও বইতে হয় না। এই সব চাপ না থাকায় অতি স্বচ্ছন্দে তিনি ম্যাল-এর মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনতার সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক পাতিয়ে ঝুলি থেকে বার করতে থাকেন একের পর এক প্রকল্পের প্রস্তাব। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা-পানীয় জল সহ নানা মৌলিক পরিষেবাগুলি থেকে প্রায় বঞ্চিত, মোর্চা-আহূত অন্তহীন বন্ধ-এর ‘সিলসিলা’য় বীতশ্রদ্ধ স্থানীয় মানুষ এ-সব ঘোষণায় স্বভাবতই উদ্বেল হয়ে ওঠে।
এরই ফাঁকে মমতা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় মিতালির সম্পর্কের জোরে সেরে ফেলেন সবচেয়ে জরুরি প্রশাসনিক/রাজনৈতিক উচ্চারণ: দার্জিলিঙের উন্নতির জন্য জান কবুল, কিন্তু আপনাদের আমরা ছেড়ে দিতে (আলাদা হতে দিতে) পারব না।
এমত ঘোষণায় মোর্চা নেতৃত্ব ঈষৎ অস্বস্তিতে পড়েন। যেমন অস্বস্তিতে পড়েছিলেন মমতা, যখন সভার মাঝে শ্রোতাদের একাংশ গোর্খাল্যান্ডের স্লোগান দেয় বা সভায় আমন্ত্রিত এক শিল্পী তাঁর গানে গোর্খাল্যান্ডের জন্য শিপচু-র শহিদদের জয়ধ্বনি করেন। আসলে, মোর্চা নেতৃত্ব যদি ভাবেন, উন্নয়ন বা শান্তি-সুস্থিতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেবল আত্মপরিচয়ের রাজনীতির ভরসাতেই তরী পার করবেন, তা হলে যেমন ভুল করবেন, তেমনই সরকারপক্ষ যদি ভাবেন, কেবল উন্নয়নের বন্যা বইয়েই আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে গড়া স্বশাসনের দাবি অগ্রাহ্য করা যাবে, তবে তা-ও সুবিবেচনার সাক্ষ্য দেবে না। তা হলে তো পঞ্জাবে কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধত না।
আসলে দরকার নজর রাখা। জি টি এ-র মধ্য দিয়ে যেটুকু সুযোগ পাহাড়বাসী পেয়েছে, তা যেন কোনও ‘নতুন ঘিসিং’-এর কুক্ষিগত না হয়। এটা নিশ্চিত হতে পারে জি টি এ-র বিভিন্ন কাজে (কেবল ভোটদানের ক্ষেত্রে নয়) জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত/গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এটা দেখা সরকারের প্রাথমিক কাজ। আর, পাহাড়-ডুয়ার্সের সংঘর্ষ এড়াতে (ভবিষ্যতে জাতিদাঙ্গার সম্ভাবনা এড়াতে) আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজন কিছু সমস্বার্থের ক্ষেত্র নির্মাণ, যা ভাষা/দৈহিক-গড়নভিত্তিক এথনিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে, এই দুই অঞ্চলের মানুষদের ভাল ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নে পরস্পরের হাত ধরতে শেখাবে। মমতা তরাই-ডুয়ার্স-পাহাড় নিয়ে একটি সামগ্রিক ভ্রমণ-প্যাকেজ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। কে জানে, হয়তো সাধারণ ক্ষেত্রে এমনই স্বার্থের বিনিময় বিবদমান দুই পক্ষকে ভবিষ্যতে দাঁড় করাবে মতবিনিময়ের, বার্তালাপ চালানোর দোরগোড়ায়।

লেখক শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.