প্রবন্ধ ৩...
কী হবে তথ্য নিয়ে, যদি কেটে যায় তিন বছর?
লাল ফিতের ফাঁস যাতে ফাঁসি হয়ে সাধারণ মানুষের গলায় না বসে, তার জন্য রাষ্ট্র তার হাতে তুলে দিয়েছিল তথ্যের অধিকার। যে কোনও অন্যায়, বঞ্চনার জন্য সরকারের জবাবদিহি তলব করতে পারেন রামা কৈবর্ত, হাসিম শেখরা। সরকারি কর্তাকে এক মাসের মধ্যে সেই তথ্য জানাতে হবে। সাধারণ নাগরিকের জন্য এত শক্তিশালী অস্ত্র কমই আছে। কিন্তু সত্যি কি তা-ই হচ্ছে?
পুরুলিয়ার একটি অনগ্রসর ব্লকের গ্রামবাসীরা চিঠি লিখেছিলেন উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে। একশো দিনের কাজ প্রকল্পে ছোট বাঁধ তৈরির জন্য বরাদ্দ টাকা কী ভাবে খরচ হয়েছে, তার কাগজপত্র দেখতে চেয়েছিলেন তাঁরা। অবাক হয়েছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের মেজ-ছোট কর্তারা। কারণ বাসিন্দারা অবিলম্বে মজুরি মিটিয়ে দেওয়ার আন্দোলন করেননি। প্রায় বছর খানেক স্থানীয় পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসের কর্তাদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন গ্রামের মানুষগুলো। প্রথমে শুনলেন, তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিছু দিন পরে শুনলেন, কাগজপত্র বড় অগোছালো, একটু সময় লাগবে। মাস খানেক পরে বলা হল, অমুকবাবু ছুটিতে আছেন। মাস ছয়েক পরে বলা হল, বড়বাবু বদলি হয়েছেন। নতুন বড়বাবু যোগ দিলে তার পরে আসুন। আরও নানা অজুহাত শোনার পর রাজ্য তথ্য কমিশনের কাছে আবেদন করলেন তাঁরা। নথির প্রতিলিপি হাতে পেতে দেখা গেল, যে শ্রমিকেরা কাজ করে মজুরি নিয়েছেন তাঁদের অনেকের অস্তিত্ব নেই। অনেকে বহু দিন আগে মারা গিয়েছেন। মালপত্র সরবরাহেও বেশ গোলমাল।
সেই তথ্য হাতিয়ার করে বাসিন্দারা শুরু করলেন ‘সোশ্যাল অডিট’। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসক, ভূমিহীন মজুর, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার সকলের কাছেই জানতে চাওয়া হল, কেন এমন হয়েছে? শেষে ওই প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার এবং পঞ্চায়েত প্রধান গ্রামবাসীর ‘হাপিস’-করা টাকা ফেরত দিলেন। সেই টাকা জমা করা হল বিডিও-র দফতরে।
তথ্যের অধিকার আন্দোলনের নেতা অখিল গগৈ-এর (বসে, বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)
নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনশন। গুয়াহাটি, এপ্রিল ২০১১
নদিয়ার চাপড়ার বাসিন্দা আলি ইন্তাজ মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) রাজ্য তথ্য কমিশনে আবেদন করেছিলেন। বছর কয়েক আগে তাঁর ছেলের মৃত্যু হয় জলে ডুবে। প্রথমে দুর্ঘটনা মনে হলেও ময়না-তদন্তে জানা যায় শ্বাসরোধ করে খুন। থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। কিন্তু বছর গড়ালেও জানতে পারেননি মৃত্যুর মামলা কী অবস্থায় রয়েছে। নানা দফতরের দরজায় দরজায় চক্কর কেটে অবশেষে তিনি রাজ্য তথ্য কমিশনের কাছে আবেদন করে এর বিহিত চান। তথ্য কমিশন জেলার সিজেএম এবং পুলিশ সুপারকে ইন্তাজ মণ্ডলের চাওয়া তথ্য দিতে নির্দেশ দেন। ছেলের মৃত্যুর মামলার তথ্য পেয়েছেন বৃদ্ধ। কিন্তু গড়িয়ে গিয়েছে তিন বছর।
রামা কৈবর্ত, হাসিম শেখেরা যাতে তথ্যের অধিকার কাজে লাগাতে না-পারে, তার প্রধান উপায় হল তাঁদের নাকাল করা, হয়রান করা, অতিরিক্ত দেরি করা। এ কেবল কিছু অসৎ আমলা কিংবা পুলিশের কারসাজি নয়। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এর পিছনে সরকারি ব্যবস্থাপনারও মদত রয়েছে।

তথ্য চেয়ে যদি না পাওয়া যায়, তবে শেষ পর্যন্ত দ্বারস্থ হতে হবে রাজ্য তথ্য কমিশনের। আবেদনকারীর বক্তব্য শুনে কমিশন সরকারি কর্মীদের ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে, শাস্তির সুপারিশও করতে পারে। অথচ, এ রাজ্যে তথ্য কমিশন যেন পক্ষাঘাতে অচল। গত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার আবেদন জমা পড়েছে তথ্য কমিশনের কাছে। সাড়ে তিন হাজার আবেদনের এখনও কোনও শুনানি হয়নি। কবে হবে, কেউ জানে না। প্রতি মাসে গড়ে চল্লিশটি আবেদনের শুনানি হয়। রায় দিতে দিতে কেটে যায় অনেক সময়। রাজ্যের মুখ্য তথ্য কমিশনার সুজিত সরকার বলেন, “বর্তমানে দু’জন কমিশনার। আমরা যত দ্রুত সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করি।” সরকারের কাছে আরও দু’জন কমিশনার চাওয়া হয়েছে, নতুন বাড়ি তৈরির দাবি জানানো হয়েছে। স্বাভাবিক, কেননা এখন শুনানির জন্য ঘর একটি। ফলে দু’জন কমিশনার এক সঙ্গে শুনানি করতে পারেন না। অবস্থা এমনই যে, আজ আবেদন করলে তার শুনানি তিন বছরের আগে হওয়া কঠিন। তত দিনে সেই তথ্য পেয়ে ঠিক কতটা কাজে লাগবে তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।

যেখানে গোটা রাজ্যের মানুষের অভিযোগ-আবেদন জমা পড়ে, সেখানে শুনানির জন্য মাত্র দু’জন কেন? রাজ্য সরকার মাত্র এক জন দিয়ে বেশ ক’বছর কাজ চালিয়েছিল, শেষে আইনি জটিলতার কারণে আরও এক জনকে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও তথ্যের অধিকার আইনে দশ জন পর্যন্ত সদস্য নিয়োগ করার ব্যবস্থা রয়েছে।
তথ্য কমিশনার পদে কেবলমাত্র প্রাক্তন সরকারি আমলাদের নিয়োগ করা কতটা সঙ্গত, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। অন্যান্য নানা রাজ্যে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে যাঁরা তথ্যের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন, বা সাংবাদিক হিসেবে যাঁরা এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাঁদের তথ্য কমিশনের নেতৃত্বে আনা হচ্ছে। তথ্যের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত নিখিল দে, তিনি অরুণা রায়েরও ঘনিষ্ঠ সহকারী। তিনি বলেন, ‘তথ্যের অধিকার আইন আরও ভাল কাজ করত, যদি তথ্য কমিশনে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বাড়ানো যেত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো আরও বেশ কিছু রাজ্যে অবস্থা সত্যিই খারাপ। আসলে তথ্য কমিশনারের পদে নিয়োগ ঠিক করার কমিটিতে সব সময়েই শাসক দলের পাল্লা ভারী থাকে, আর তার প্রভাব পড়ে কমিশনে।’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক অতিরিক্ত জেলাশাসকের কাছে উন্নয়ন সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য চেয়েছিলেন এক নাগরিক। অতিরিক্ত জেলাশাসক সেই তথ্য দেননি। জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেও প্রয়োজনীয় তথ্য মেলেনি। ফলে তিনি দ্বারস্থ হ’ন রাজ্য তথ্য কমিশনের। কমিশনের তরফে জেলাশাসককে প্রয়োজনীয় তথ্য বাসিন্দাকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তথ্য কমিশনের নির্দেশকেও পাত্তা দেননি ওই আই এ এস অফিসার। বাধ্য হয়ে তথ্য কমিশন মহাকরণে স্বরাষ্ট্র দফতরের (পার্সোনেল) বিভাগে অতিরিক্ত জেলাশাসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। অতিরিক্ত জেলাশাসককে শো-কজ করেন বিভাগীয় কর্তারা। তার পরেই উচ্চ আদালতে যান অতিরিক্ত জেলাশাসক। যত দিন মামলা চলবে, তত দিন তিনি মুখ খুলতে বাধ্য নন।

যে তথ্য সমাজের সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা দাবি করার ক্ষেত্রে সমাজের সকলের, বিশেষত যুব সমাজের সচেতনতা দরকার। আর শুধু তথ্য পেলেই তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় না। আইনের সাহায্যে তথ্য পাওয়া গেলেও তা ব্যবহার করে ছবিটা বদলাতে চাই আন্দোলন। নাগরিক সমাজ তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বও অস্বীকার করা যায় না।
তথ্যের অধিকার আইনের প্রায় ছ’বছর হয়ে গিয়েছে। আমাদের রাজ্যে তথ্য কমিশন ও তার কাজ কমবেশি তিন বছরের। এক দিকে স্পষ্ট হয়েছে, এই আইন ব্যবহার করে সামান্য নাগরিকও রাষ্ট্রকে নতজানু করতে পারে, অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে যে এই আইনকে দুর্বল, ছিদ্রবহুল করে তুলতে নানা পদ্ধতির চর্চা চলছে। বোঝা যাচ্ছে, আইন তৈরি করলেই হয় না, তাকে বাঁচিয়ে রাখতেও আন্দোলন করে যেতে হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.