ভারতের দুনিয়ায় দু’নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা নাকি শুধু
সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, তখন যাঁরা সবার নীচে থাকবেন, তাঁদের উন্নয়ন?
এখনই সেই সর্বজনীন উন্নয়নের কথা ভাবা প্রয়োজন। শত্রুজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় |
গোটা দুনিয়ার অর্থনৈতিক মানচিত্রে ভারতের অবস্থান কী দাঁড়াবে, সে বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা, ভবিষ্যৎবাণী হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অনুমানটি ‘দ্য ইকনমিস্ট’ পত্রিকার। এই পত্রিকা ২০০৮ সালে একটা তালিকা প্রকাশ করে। ২০১০ সাল থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী দাঁড়াবে, তার প্রতি পাঁচ বছর অন্তরের অনুমান। বিশ্বের সব প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিসম্পন্ন দেশই সেই তালিকায় ছিল। সেই তালিকা বলছে, ২০৫০ সালে ভারত ডলারের হিসেবে গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট বা অভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদনের (সংক্ষেপে, জিডিপি) নিরিখে আমেরিকার সমান হবে। ভারতের আগে থাকবে একমাত্র চিন। এই হিসেবটি করার সময় ধরে নেওয়া হয়েছে, ২০২৫ সালের পর চিনের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার খুবই কমে আসবে এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বয়স বাড়ার ফলে ও ‘এক সন্তান নীতি’-র কারণে সে দেশের উৎপাদনশীলতা কমবে। আর ভারতে তখন এক বিরাট তরুণ কর্মক্ষম প্রজন্ম তাদের দক্ষতার চরমে থাকবে, ফলে ভারতে বিনিয়োগও আসবে অনেক বেশি।
ভারতীয় সরকারকে দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার আনন্দের উদ্যাপন শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার জন্য বিস্তর তদ্বির আরম্ভ করেছে। বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান কেনার বায়না করে ফেলেছে, উন্নতমানের বন্দুক, পরমাণু-শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনা হচ্ছে। বিপুল খরচ সত্ত্বেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি হচ্ছে ভারত। এবং, তার জন্য বিভিন্ন দেশকে প্রায় ঘাড়ে ধরে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে এই চুল্লিগুলিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি হবে না। |
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির বাসিন্দা হলে ঠিক কেমন লাগবে? উত্তর সহজ। দেশের মানুষ কতটা ভাল থাকবেন, তা জিডিপি-র ওপর নির্ভর করে না। দেশে মাথাপিছু কত টাকা আয়, মানুষের ভাল থাকা নির্ভর করে তার ওপর। ‘দ্য ইকনমিস্ট’ সমীক্ষাটি জানিয়েছে, আগামী চল্লিশ বছরে ভারতের জিডিপি বাড়বে সাড়ে পঁচিশ গুণ! বিপুল বৃদ্ধি। কিন্তু তার পরেও, ভারতের জিডিপি, ডলারের হিসেবে এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতার হিসেবে, চিনের জিডিপি-র অর্ধেকেরও কম হবে। ভারতে মাথাপিছু আয়ও হবে চিনের অর্ধেকের কম। কিন্তু, জিডিপি-র হিসেবের বাইরেও কিছু থেকে যায়। বস্তুত, সেগুলোই বেশি জরুরি। এখন থেকে যে দল বা জোট ভারত শাসন করবেন, তাঁদের চিন্তাভাবনা যদি না বদলায়, তবে ২০৫০ সালে ভারতে আয়ের হিসেবে শেষ ২০ শতাংশ মানুষের অবস্থা সাব-সাহারান আফ্রিকার মানুষের চেয়ে একটুও ভাল হবে না। তুলনাটা খেয়াল করা ভাল সাব-সাহারান আফ্রিকা, অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকেই, বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। ভারতের এই তলানির ২০ শতাংশ মানুষের অর্ধেক তখনও নিরক্ষর থাকবেন, থাকার মতো বাড়ি থাকবে না, জলের ব্যবস্থা থাকবে না, শৌচাগারও না। এখন শিল্পক্ষেত্রে যে কাজ করতে যত শ্রমিক দরকার হয়, ভবিষ্যতে তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক শ্রমিক সেই কাজ করে ফেলতে পারবেন। ফলে, শিল্পে কম কর্মী লাগবে। আর, শিল্পক্ষেত্রে একেবারে কম দক্ষতার কাজের জন্যও তখন খানিকটা লেখাপড়া শেখার, প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। এবং, ভারতের উত্থান প্রধানত পরিষেবা ক্ষেত্রে। কাজেই, যথেষ্ট লেখাপড়া না শিখলে কাজের অভাব হবেই। আর, যে বিপুল শ্রমশক্তির কথা মাথায় রেখে ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানের আলোচনা চলছে, সেই শ্রমশক্তি মালিকের পক্ষে খুব লাভজনক, কিন্তু, তাতে বেতনের হার কমবে। ফলে, যাঁরা শেষ ২০ শতাংশে পড়ে থাকবেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ বেশ অন্ধকার।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব অনেক। সেই দায়িত্ব পালনে সরকারের উদ্যোগ, অন্তত এখন পর্যন্ত, দায়সারা। মহাত্মা গাঁধী জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা তৈরি হয়েছে, যাতে দরিদ্র মানুষ অন্তত অভুক্ত না থাকেন। কিন্তু, পুরো দেশে এই যোজনা চালিয়ে যাওয়া বিপুল আর্থিক চ্যালেঞ্জ। উল্টো দিকে, দালাল আর ফড়েরাই লাভের গুড় খাবে, এই আশঙ্কায় যোজনাটি ঠিক ভাবে চালু না করাও বোকামি। আর একটি প্রকল্পকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের সব মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান জানা সম্ভব হবে। এবং, মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণিকে এড়িয়ে সরাসরি গরিব মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যাবে।
দারিদ্র দূর না হওয়া পর্যন্ত যে এই প্রাথমিক জিনিসগুলো চালিয়ে যাওয়া উচিত, এই কথায় খুব কেউ দ্বিমত হবেন বলে বোধ হয় না। কিন্তু, একটি দেশের সমৃদ্ধি নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর, রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষমতার ওপর। রাজস্ব কী ভাবে বণ্টিত হবে, সেটাও জরুরি প্রশ্ন। ভারতের একটা বড় মুশকিল, এ দেশে যাঁদের সরকারি ভর্তুকি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাঁদের মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যে জোর করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তা বেশ বোঝা গিয়েছে। এটাও জানা যে শিক্ষার প্রসার হলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিজে থেকেই কমে। কিন্তু, প্রক্রিয়াটি শ্লথ। সেই ভরসায় থাকলে বহু বছর লাগবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রচার এখনই আরম্ভ করতে হবে। তাতে কিছু আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা থাকলে ভাল।
ভারতের আরও একটি সমস্যা হল পরিকাঠামোর অভাব। গাড়ি চলার মতো রাস্তা নেই, যথেষ্ট বিদ্যুৎ নেই। শুধু এই দুটির ব্যবস্থা করা গেলে কোনও বাড়তি সরকারি সাহায্য বা উদ্যোগ ছাড়াই একটি অঞ্চলের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসা সম্ভব। কিন্তু, এই ক্ষেত্রগুলিতে সরকারের উদ্যোগের রেকর্ড খুব খারাপ। আন্তর্জাতিক প্রবণতার কথা মাথায় রাখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যেই এই দেশের প্রধান শহরগুলিতে জনসংখ্যা ২৫ শতাংশেরও বেশি বাড়বে। গ্রাম থেকে মানুষ সুযোগের সন্ধানে শহরে আসবেন। এই সমস্যা সামাল দেওয়ার একটাই উপায় উপনগর গড়ে তোলা। তার জন্য দ্রুত গতির গণ পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই সব কাজে বিপুল খরচ। ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যেরই যা অবস্থা, তাতে এই খরচের একটা অংশ বহন করার সামর্থ্য নেই। যে খরচে দেশের আর্থিক উন্নয়ন হয় না, কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন খরচ করা চলবে না। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নয়নের দায়িত্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে বাড়তি রাজস্ব জোগাড় করতে হবে। যাঁরা যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও করের আওতার বাইরে, তাঁদের করের আওতায় এনে এই বাড়তি রাজস্বের একটি অংশ জোগাড় করা যেতেই পারে। কিন্তু, শুধু সেটুকুতেই চলবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের মাধ্যমেও টাকা জোগাড় করতে হবে। সরকার ৫১ শতাংশ শেয়ার হাতে রেখে বাকিটা বেচে দিক। দেশের বহু মানুষ যখন এখনও ‘দিন আনি দিন খাই’ বা তার চেয়েও খারাপ অবস্থায়, তখন সরকারের সিন্দুকে সম্পত্তি জমিয়ে রাখার মানে কী?
ভারতে এই কাজগুলো ঠিক ভাবে করলে জিডিপি, মাথাপিছু আয় নিজে থেকেই উন্নত হবে। তখন জগৎসভায় আসনের জন্য অন্যদের সঙ্গে জবরদস্তি করতে হবে না। |