দল প্রধানমন্ত্রী করতে চাইলে মানা করব কেন |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (আডবাণীর সফরসঙ্গী) • নাগপুর |
দল যদি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করতে রাজি থাকে, তাঁর আপত্তি নেই। আজ নাগপুরে পৌঁছনোর আগে রথে বসে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, যাঁকেই প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করা হোক, সেটা মানুষ জানতে চায়। তাই ভোটের আগেই প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা উচিত। তাঁর সাফ কথা, “আমি দলের সভাপতি হলে সেটাই করতাম।”
আরএসএস চাইছে, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটপর্ব মিটে গেলে পরিস্থিতি বিচার করে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করুক বিজেপি। সে দিক থেকে আডবাণীর এই কথা তাৎপর্যপূর্ণ। একই রকম তাৎপর্যপূর্ণ দলীয় সভাপতির প্রতি তাঁর পরোক্ষ বার্তাটিও।
সব মিলিয়ে, বিজেপির অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রী-বিতর্ক জিইয়েই রাখলেন আডবাণী।
সরাসরি প্রশ্ন করা হলে কিন্তু আডবাণী বলছেন, তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে নেই। এ বারেও বললেন, “আগেই তো বলেছি, আমি প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে নেই।” কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করা কি ভুল? আডবাণীর জবাব, “আমি অন্তত ভুল বলে মনে করি না। কিন্তু আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই।” তাঁর বক্তব্য, “২০০৯ সালে যখন আমাকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তুলে ধরা হয়েছিল, তখনও দলের সহযোগীরাই সেই সিদ্ধান্ত নেন। যদিও পাকিস্তান সফরের ব্যাপারে দলের অনেকে খুশি ছিলেন না।”
তিনি যে সব সময় দলীয় নির্দেশ মেনে কাজ করেছে, সে কথা বুঝিয়ে আডবাণী এর পরে বলেন, “দল যখন আমাকে সভাপতি হতে বলে, তখন সভাপতি হয়েছি। যখন বাজপেয়ীজি উপপ্রধানমন্ত্রী হতে বলেন, হয়েছি।”
তা হলে আগামী লোকসভা নির্বাচনের সময় দল যদি আপনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে বলেন, তা হলে হবেন? আডবাণীর সাফ জবাব, “আমি কেন বারণ করব? কিন্তু এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। আমার স্বাস্থ্য কেমন থাকে, সেটা দেখার বিষয়। তার পর এখনই যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়! কেউ তো তা আগাম বলতে পারে না। এখন তো কোনও নির্বাচনও হচ্ছে না।” |
১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নাম কিন্তু আডবাণীই দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সম্প্রতি বারাণসীতে উমা ভারতী সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন আবার। তা হলে এ বার আডবাণী
কারও নাম ঘোষণা করছেন না কেন? আডবাণীর বক্তব্য, “আমি তো এখন দলের সভাপতি নই। বাজপেয়ীর সময় আমি দলের সভাপতি ছিলাম।” এর পরেই তিনি বলেন, “যদি এখন সভাপতি হতাম, তা হলে কারও নাম ঘোষণা করে দিতাম।”
এই দু’টি মন্তব্যকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, আডবাণী যতই সরাসরি প্রশ্নের জবাবে বলুন, তিনি দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে নেই, কিন্তু পরোক্ষে নিজেকে সেই দৌড়ে রেখেই দিলেন। একই সঙ্গে বাজপেয়ীর প্রসঙ্গে চাপ সৃষ্টি করলেন দলীয় সভাপতি নিতিন গডকড়ীর উপরে। বা বলা যায়, সঙ্ঘের উপরেই। তিনি ভাল ভাবেই জানেন, এখন যা পরিস্থিতি তাতে দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে কাউকে দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে আগাম ঘোষণা করা কঠিন। এই পরিস্থিতি ২০১৪ সালেও বিশেষ বদলাবে না বলেই অনেকের ধারণা। বিজেপি রাজনীতির ব্যাপারে যাঁরা ওয়াকিবহাল তাঁদের বক্তব্য, এটা ধরে নিয়েই সম্ভবত চাপ তৈরির পথ নিলেন আডবাণী। এবং একই সঙ্গে জানিয়েও দিলেন, দল কিন্তু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।
১৯৯০ সালে, ভিপি সিংহের জমানার সময় রথ নিয়ে বেরিয়েছিলেন আডবাণী। তখন তিনি ছিলেন উগ্র হিন্দুত্ব ও সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদের নায়ক ছিলেন। একুশ বছর পরে তাঁর রথযাত্রা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনচেতনা বাড়াতে। একই সঙ্গে এনডিএ-র কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টাও রয়েছে। এই দুই আডবাণীর মধ্যে কী ফারাক? তিনি কি হিন্দুত্বের বিষয়টিকে ছেড়ে দিয়েছেন?
আডবাণী বলছেন, একুশ বছরের ব্যবধানে ফারাকটা শুধু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার। কিন্তু এই আডবাণী উগ্র হিন্দুত্বের বাহক নন। বরং বলছেন, “আমি কিন্তু কখনওই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভুল বলে মনে করিনি। ‘আসল ধর্মনিরপেক্ষতা’ হল, যে কোনও ধর্মকে গ্রহণ করা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু বিজেপি বা কংগ্রেসই মানে না, এটা দেশের ঐতিহ্য।”
একই সঙ্গে হিন্দুত্বকেও ধরে রেখে তাঁর বক্তব্য, “দীনদয়াল উপাধ্যায় বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ব আসলে ভারতীয়ত্বেরই নামান্তর। ফলে হিন্দুত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে, এ কথা ঠিক নয়। হিন্দুত্বের ব্যাপারে এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশের ঐতিহ্যের মানকে লঘু করে। ধর্ম এবং ধার্মিকতা সত্য। ভারতে ধর্মের নাম নিলে লোক শুধু দাঙ্গার কথা ভাবে।”
রথযাত্রায় অবশ্য দুর্নীতির বিষয়গুলিই তুলে ধরছেন আডবাণী। সভায় সভায় টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, সুইস ব্যাঙ্কের কালো টাকার কথা বলছেন। এবং তাঁর দাবি, গ্রামগঞ্জের মানুষ সে সব বুঝতেও পারছে। বললেন, “লোকে সব বোঝে। ভারতের আম-নাগরিক যদি শিক্ষিত না-ও হন, তা হলেও তাঁদের রাজনৈতিক বোধ যথেষ্ট।
আমি যখন বলি, তিহাড়েই এ বারে ক্যাবিনেট বৈঠক হবে, তখন সাধারণ মানুষ সে কথা ভাল ভাবেই বুঝতে পারে। লক্ষ কোটি টাকার হিসাব না বুঝলেও মূল বিষয়টি ধরতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার যে দুর্নীতিতে লিপ্ত হচ্ছে, তা বিলক্ষণ বোঝে।
মজার বিষয় হল, আডবাণীর যাত্রার সূচনা করেছেন নীতীশ কুমার এবং নরেন্দ্র মোদী ব্লগে এই যাত্রাকে সমর্থন করেছেন। তা হলে কি মনে করা যায়, দু’জনের মধ্যে মতবিরোধ শেষ হয়ে গিয়েছে? আর পরের বার মোদী বিহারে ও নীতীশ গুজরাতে প্রচার করতে যাবেন?
হাসতে হাসতে এই জবাব এড়িয়ে গেলেন আডবাণী! |