|
|
|
|
ছেলের মৃত্যুতে এখন মাথা চাপড়াচ্ছেন বৃদ্ধ গোপীনাথ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • খানাকুল |
‘প্রাণের ভয়ে’ গত ২০ জুলাই থেকে খানাকুলের রঞ্জিতবাটি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন না সিপিএম নেতা মহাদেব মণ্ডল। দলের খানাকুল জোনাল অফিসের কাছে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। শনিবার তাঁর বাবা গোপীনাথ গিয়েছিলেন ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। বাবাকে বাইকে করে রঞ্জিতবাটির বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন মহাদেব। ফেরার পথে তাঁকে ধরে কিছু লোক। অভিযোগ, সকলেই তৃণমূলের নেতা-কর্মী-সমর্থক। তারাই সিপিএম নেতাকে পিটিয়ে মারে। ওই ঘটনায় বেশ কয়েক জন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের নামে এফআইআর দায়ের করেন মহাদেবের ভাই। ৪ জনকে শনিবার রাতেই রঞ্জিতবাটি গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। বৃদ্ধ গোপীনাথের আফশোষ, “আমি বলেছিলাম, একাই ফিরতে পারব। ও শুনল না। আমাকে পৌঁছে দিতে না এলে হয়তো এত বড় অঘটন ঘটত না!”
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতেরা হলেন কাশীনাথ মণ্ডল, অভিলাষ পাত্র, নেপাল পাত্র এবং বিশ্বকেতু হাজরা। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছ কাশীনাথবাবু গ্রামের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। বাকিরা দলের কর্মী-সমর্থক। রবিবার ধৃতদের আরামবাগ মহকুমা আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁদের ১৪ দিন জেলহাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। গ্রামে উত্তেজনা থাকায় পুলিশি টহল চলছে। |
|
নিহত মহাদেবের পরিবার। |
খানাকুলের বিধায়ক তৃণমূলের ইকবাল আহমেদ বলেন, “ধৃত বা অভিযুক্তেরা আমাদের দলের নেতা-কর্মী হতেই পারেন। কিন্তু খুনের ঘটনাটির সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই।” বিধায়কের দাবি, ধৃত কাশীনাথ মণ্ডল নিহতের জ্যাঠতুতো দাদা। দু’পক্ষের পারিবারিক কলহ ছিল। খুনের ঘটনা তারই ফল।
যদিও রাজনৈতিক কারণেই মহাদেবকে খুন করা হয়েছে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। সিপিএমের খানাকুল জোনাল কমিটির সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মুখে খালি শান্তির কথা বলছেন। আর তাঁর দলের কর্মীরা গ্রামে গ্রামে খুন-ধর্ষণ-লুঠপাট চালাচ্ছে। জরিমানা করছে।” আরামবাগের সাংসদ সিপিএমের শক্তিমোহন মালিক বলেন, “অবিলম্বে দলীয় কর্মীদের সংযত করতে পদক্ষেপ করুন মুখ্যমন্ত্রী। নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক।”
বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে খানাকুলে এই নিয়ে দু’টি খুনের ঘটনা ঘটল। গত ৯ সেপ্টেম্বর শশাপোতা গ্রামে খুন হন সিপিএমের কর্মী স্বপন সর। এর আগে রঞ্জিতবাটি গ্রামেও রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৮ সালে সিপিএম কর্মী দেবেন বরকে খুন করা হয়। ২০০০ সালে খুন হন তৃণমূল কর্মী নিতাই পাত্র।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকেই তৃণমূল ও সিপিএমের মধ্যে অশান্তি বেড়েছিল এই এলাকায়। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের নামে তৃণমূলের লোকজন কয়েক জনকে মারধর করে বলে অভিযোগ। মহাদেববাবুর বাড়িতেও সে সময়ে হামলা হয়েছিল। তাঁর বাড়ি থেকে অস্ত্র না মিললেও বাড়ির কাছেই একটি পরিত্যক্ত এলাকা থেকে কিছু বোমা উদ্ধার হয়। ২১ জুলাই ব্রিগেডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার আগে গ্রামের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। ২০ জুলাই রাতে গ্রাম ছাড়েন মহাদেববাবু-সহ জনা পনেরো সিপিএম কর্মী-সমর্থক।
বাড়ি থেকে পালিয়ে কিছু দিন খানাকুলে সিপিএমের জোনাল কমিটির অফিসে আশ্রয় নিয়েছিলেন মহাদেববাবু। পরে ওই অফিসের কাছেই ঘরভাড়া নেন। গণেশপুর গ্রামে তাঁর কাঠের গোলাটি বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকেই তৃণমূলের লোকজন বন্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি খানাকুল ২ পঞ্চায়েত সমিতির একটি নদীঘাট ইজারা নিয়েছিলেন তিনি।
শনিবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে মহাদেববাবুর সেজো ভাই দিলীপ, ছোটভাইয়ের স্ত্রী কাজলিরা বলেন, “বাবাকে ঘরে নামিয়ে দাদা আর দাঁড়াননি। বাইক ঘুরিয়ে চলে যান। দু’তিন মিনিটের মধ্যেই খবর পাই, দাদাকে ঘিরে ধরে মারছে তৃণমূলের ছেলেরা। গিয়ে দেখি জনা দ’শেক গ্রামেরই লোক। আমরা হাতে-পায়ে ধরে বললাম, ছেড়ে দাও। শুনল না। দেখতে দেখতে আরও জনা কুড়ি লোক জুটে গেল। তাদের হাতে লাঠি-বল্লম, কাটারি। কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। মারতে মারতে মানুষটাকে ওরা বালিগোড়ির দিকে নিয়ে গেল।”
নিহতের স্ত্রী গৌরীদেবী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করব, এই সর্বনাশা রাজনীতি বন্ধ করুন। আমার ছেলের জীবনও বিপন্ন। আমাদের রক্ষা করুন।” মণ্ডল দম্পতির ছেলে বিপ্লব দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। গত ২০ জুলাই রাতে তাকে তৃণমূলের লোকজন অপহরণ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য পুলিশ উদ্ধার করে তাকে।
|
খানাকুলে মোহন দাসের তোলা ছবি। |
|
|
|
|
|