দীপাবলির মুখে বিদ্যুতে
আঁধার নামাচ্ছে কয়লা
খোদ দিল্লির দেওয়ালিই এ বার ম্লান করে দিতে পারে কয়লার আকাল। নানা কারণে একই আশঙ্কা গভীর হচ্ছে বাংলার কালীপুজো ঘিরেও।
কয়লার চাহিদা আর জোগানে এতই ফারাক যে গোটা দেশেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ধুঁকছে। অথচ কয়লা মন্ত্রক সে ভাবে আশার আলো দেখাতে পারছে না। ফলে স্পেকট্রাম-অন্না-তেলেঙ্গানা ছাপিয়ে মনমোহন সরকারের নতুন মাথাব্যথা এখন কয়লাই। রাজ্যে রাজ্যে বিদ্যুতের আকাল কাটাতে প্রধানমন্ত্রী তাই জরুরি বৈঠক ডেকেছেন এ মাসের শেষে। থাকবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। এরই মধ্যে গোদের উপরে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, কোল ইন্ডিয়ায় কর্মী অসন্তোষ ও লাগাতার ধর্মঘটের হুমকি।
সরকার যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লার জোগান বাড়াতে তৎপর, ঠিক সেই সময়েই বাড়তি বোনাস ও বেতন কাঠামো সংশোধনের দাবিতে গত ১০ অক্টোবর ধর্মঘট করেছেন কোল ইন্ডিয়ার কর্মীরা। তাতে দাবি-দাওয়া না মেটায় এ বার ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘটের হুমকি দিল সংস্থার শ্রমিক সংগঠনগুলি। আইএনটিইউসি, সিটু, এআইটিইউসি, হিন্দ মজদুর সভা ও ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এই পাঁচ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তিন লাখের বেশি কোল ইন্ডিয়া কর্মী ও আরও দু’লাখ ঠিকাকর্মী ধর্মঘটে নামলে বিদ্যুৎ সঙ্কট আরও মারাত্মক আকার নেওয়ার আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে কয়লা মন্ত্রক আগামিকালই ওই সংস্থার শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসবে।
দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সঙ্কট দেখা দিলেও কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্ডে কিন্তু এ দিনও আশ্বাস দিয়েছেন, দেওয়ালির আগেই পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হবে। তাঁর যুক্তি, সমস্যার সমাধানে বিদ্যুৎ মন্ত্রক বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে। দেখা গিয়েছে, কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অতিরিক্ত কয়লা মজুত রয়েছে। তাই সেখান থেকে কয়লা পাঠানো হচ্ছে, জ্বালানিতে টান ধরেছে এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে। পাশাপাশি, কয়লা ও রেল মন্ত্রকের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। রেলের কাছ থেকে অতিরিক্ত রেক চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রকের দাবি, সাময়িক ভাবে হলেও পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে।
কয়লা মন্ত্রকের কর্তারা অবশ্য বলছেন, এ সবই সাময়িক সমাধান। দীর্ঘমেয়াদে এ ভাবে বিদ্যুতের ঘাটতি ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাবে না। কয়লা মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, কয়লা মজুত না থাকায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে সঙ্কট এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, বেশ কিছু ইউনিট বন্ধ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা এনটিপিসি-র অধিকাংশ উৎপাদন কেন্দ্রই এখন কয়লার অভাবে পূর্ণ মাত্রায় কাজ করতে পারছে না। রাজধানী দিল্লি, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও বিরাট পরিমাণে বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
কয়লা মন্ত্রকের হিসেবে, দেশের ৮৬টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪৪টির অবস্থা উদ্বেগজনক। কারণ, সেখানে সাত দিনের কয়লা মজুত নেই। ‘খুবই উদ্বেগজনক’ অবস্থা ২৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। কারণ, সেখানে চার দিনেরও কম কয়লা মজুত রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও বিহারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির নাম। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীও মানছেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। শিন্ডের বক্তব্য, অন্তত ১০-১২ দিনের অতিরিক্ত কয়লা মজুত না থাকলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি পূণর্মাত্রায় উৎপাদন করতে পারে না।
পরিস্থিতি এতই উদ্বেগজনক যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লা সঙ্কট নিয়ে চলতি মাসের শেষে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য, খনিগুলি থেকে যাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার জোগান অব্যাহত থাকে, সেটা নিশ্চিত করা। খনি থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পৌঁছয় রেলের মাধ্যমে। বৈঠকে তাই বিদ্যুৎ, কয়লা ও রেলমন্ত্রীর থাকার কথা। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইছেন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। সে কারণে যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াকেও ডাকা হয়েছে ওই বৈঠকে।
কিন্তু এই কয়লা সঙ্কটের কারণটা কী?
কয়লা মন্ত্রকের হিসেবে, গত পাঁচ বছর ধরে দেশে কয়লার চাহিদা অস্বাভাবিক হারে (৮ শতাংশ) বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন বাড়েনি সেই তুলনায়। চলতি আর্থিক বর্ষে কয়লার চাহিদা ৬৯ কোটি ৬০ লক্ষ টনে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সেখানে খনি থেকে কয়লা পাওয়া যাবে মাত্র ৫৫ কোটি ৪০ লক্ষ টন। অর্থাৎ ১৪ কোটি ২০ লক্ষ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। যোজনা কমিশনের হিসেবে, দ্বাদশ যোজনাকালের শেষে (২০১২-’১৭) কয়লার বার্ষিক চাহিদা ১০০ কোটি টনে গিয়ে পৌঁছবে। এই সময়ে যদি টেনেটুনে ২০ কোটি টনও উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাতেও প্রায় ২২ থেকে ২৫ কোটি টন ঘাটতি থেকে যাবে, যা আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হবে। কিন্তু আমদানি করা কয়লার দাম বেশি। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বাড়বে। যার বোঝা চাপবে সাধারণ মানুষের উপর।
কয়লা সঙ্কটের অন্য কারণও রয়েছে। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের ফলে সিঙ্গারেনি খনিতে ধর্মঘট চলছে। বন্যায় বিঘ্নিত হয়েছে সরবরাহ। এর মধ্যেই গত ১০ অক্টোবর কোল ইন্ডিয়ায় শ্রমিক সংগঠনগুলি ধর্মঘটের ডাক দেয়।
তবে এ সবের ফলে দেশের অন্যত্র কয়লার অভাব দেখা দিলেও পশ্চিমবঙ্গে জোগানে বিশেষ ভাটা পড়েনি। তবু দুর্গাপুজোর পর থেকেই লোডশেডিংয়ে জেরবার হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। কালীপুজোয় সিইএসসি তার এলাকা আলোকিত রাখার আশ্বাস দিলেও বাকি বাংলায় দীপাবলি ঘিরে আশঙ্কা রয়েছে।
কেন? কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের তরফে বলা হচ্ছে, দেশের অন্যান্য অংশের থেকে পশ্চিমবঙ্গে কয়লা-সঙ্কটের মূলগত ফারাক রয়েছে। সেখানে কয়লার অভাব দেখা দিয়েছে অর্থাভাবের ফলে। রাজ্য সরকার কয়লার দামই মেটাতে পারছে না। তবে সামগ্রিক ভাবে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের অবস্থাই করুণ। তাই প্রয়োজন পড়লেও গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে রাজ্যে লোডশেডিং ঠেকানো যাচ্ছে না। সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, আপাতত খনিগুলি থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ধাপে ধাপে কয়লার জোগান বাড়ানো হচ্ছে। সপ্তাহের শুরুতে উত্তর ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে ১৪০ রেক কয়লা পাঠানো হয়েছিল। তার পরে তা দু’ধাপে বাড়িয়ে ১৪৯ রেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেওয়ালির আগে আগামী কয়েক দিনে আরও রেক বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। তাতে হয়তো বা দেওয়ালির রোশনাই অন্যান্য বারের মতোই উজ্জ্বল রাখার আশা ছিল কিছুটা, কিন্তু সেই আশায় ছাই দিয়েছে কোল ইন্ডিয়ায় কর্মীদের ধর্মঘটের হুমকি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.