বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘ট্র্যাডিশন’ অব্যাহত!
ফের সিপিএমের পলিটব্যুরো বৈঠকে গরহাজির থাকছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে আজ, সোমবার ও কাল, মঙ্গলবার পলিটব্যুরোর দু’দিনের বৈঠক আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতির জন্যই। বুদ্ধবাবুকে ছাড়াই সেখানে বঙ্গ সিপিএমের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছেন সেই তিন জন বিমান বসু, নিরুপম সেন ও মহম্মদ আমিন। দু’বছর আগে লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে ধরলে ঠিক কতগুলি পলিটব্যুরোর বৈঠক বুদ্ধবাবু এড়িয়ে গেলেন, এ কে জি ভবনের নেতারাও এক লহমায় তা মনে করতে পারছেন না! লোকসভা ভোটের পরে দিল্লিতে একটি বৈঠকে আধ-বেলা এবং বিধানসভা ভোটের পরে কলকাতায় একটি পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক গত সওয়া দু’বছরে সাকুল্যে এই হল বুদ্ধবাবুর উপস্থিতি।
আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের তরফে বুদ্ধবাবুর শারীরিক অসুস্থতাকেই তাঁর গরহাজিরার কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে এ বার বুদ্ধবাবুকে কেন্দ্রীয় স্তরের বৈঠকে হাজির করানোর ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিতে শুরু করেছেন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। দিনের পর দিন শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ‘আড়াল’ করতে করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘ক্লান্ত’! দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা বুদ্ধবাবুর লাগাতার এমন আচরণে ভিন্ রাজ্যের নেতারা তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও রাজ্য ও জেলা স্তরে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, সিপিএম নেতৃত্ব তা বিলক্ষণ জানেন। সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট দলের অভ্যন্তরে এই নিয়ে ‘উষ্মা’ প্রকাশ করেছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোভাব বুঝে রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুও এ বারের বৈঠকে অন্তত যাওয়ার জন্য বুদ্ধবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন। আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরাও চাইছিলেন, বুদ্ধবাবু এ বার দিল্লি যান। বিমানে যেতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হলে ট্রেনে যান। কিন্তু সব ‘চাপ’ এবং ‘চেষ্টা’ ব্যর্থ করে রবিবার বিকালে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধবাবুকে ছাড়াই দিল্লির উড়ান ধরতে যেতে হল বিমানবাবুকে।
অতীতের বেশ কয়েক বারের মতো এ বারও বুদ্ধবাবুকে ‘আড়াল’ করতে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথাই বলেছেন বিমানবাবু। দিল্লি যাওয়ার আগে বুদ্ধবাবুকে নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আলিমুদ্দিনে বিমানবাবু বলেন, “বুদ্ধদেব যাচ্ছেন না। ওঁর সিওপিডি-র (ফুসফুস-জনিত শ্বাসকষ্টের সমস্যা) জন্য ওষুধ খেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে দূরে কোথাও, সে বিমানেই হোক বা ট্রেনে, যাওয়া সম্ভব নয়। অবস্থার উন্নতি হলে পরে নিশ্চয়ই যাবেন।” সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের আরও সংযোজন, “যেখানে গিয়ে কর্মসূচি করে আবার ফিরে আসা যায়, সেখানে ছাড়া অন্য কোথাও উনি যেতে চাইছেন না। আমরাও জোর করছি না।”
সেপ্টেম্বরের ২৯ ও ৩০ তারিখের পলিটব্যুরো বৈঠকে যোগ দিতে বুদ্ধবাবু দিল্লি যাননি। যদিও দলের মতাদর্শগত দলিল নিয়ে লিখিত ভাবে কিছু মতামত পাঠিয়েছিলেন। সেই ২৯ তারিখেই উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় দলীয় একটি জনসভায় গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। এ বারের পলিটব্যুরো বৈঠকের সময় এখনও পর্যন্ত তেমন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কোনও কর্মসূচি কলকাতায় বা তার আশেপাশে নেই তাঁর। এই ঘটনাপ্রবাহের জন্যই বুদ্ধবাবুর অসুস্থতার ব্যাখ্যা নিয়ে দলের অন্দরেই জোরালো প্রশ্ন উঠছে। দক্ষিণী একটি রাজ্য থেকে সিপিএমের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “সিওপিডি-র সমস্যা থাকলে ট্রেনের বাতানুকূল কামরায় এক রাতের সফরে বিশেষ কী অসুবিধা হয়? গাড়িতে করে খানাখন্দে ভরা রাস্তা ডিঙিয়ে জেলার নানা প্রান্তে ধুলোধোঁয়ায় জনসভা করতে পারছেন উনি। অথচ কলকাতার বাইরে দলের কেন্দ্রীয় স্তরের কোনও বৈঠকে আসছেন না! বিশেষ কিছু বলার থাকলে বৈঠকে এসেই বলুন না!” জেলা স্তরের কিছু নেতার আরও গুরুতর প্রশ্ন, দলের নিচু তলার কোনও কমিটিতে কোনও নেতার এমন ‘আচরণ’ কি বরদাস্ত করা হত? দিনের পর দিন পলিটব্যুরোয় গরহাজির থেকেও বুদ্ধবাবু তা হলে কেন ‘ছাড়’ পেয়ে যাবেন?
বস্তুত, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরেই ‘নৈতিক দায়’ নিয়ে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে অবশ্য বুঝিয়ে ‘নিরস্ত’ করার চেষ্টা হয়েছিল। কারাট-শিবিরের মতে, বুদ্ধবাবু যদি
নিজের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তেই ব্যক্তিগত ভাবে অনড় থাকতেন, তা হলে কলকাতার পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও হাজিরা দিতেন না। তা যখন করেননি, তখন ট্রেনে চেপেও দিল্লি না-যাওয়ার পিছনে ‘অন্য কারণ’ থাকাই স্বাভাবিক! কারাট-বিরোধী শিবিরের পাল্টা ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গে যে শিল্পায়ন ও জমি অধিগ্রহণ নীতির জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সিপিএমে বুদ্ধবাবুকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, সেই নীতিতে সিলমোহর ছিল কারাটদেরই। তা হলে এখন শুধু বুদ্ধবাবু ও তাঁর বিগত সরকারের দিকেই কেন আঙুল তোলা হচ্ছে? আর দায় যদি নিতেই হয়, গত লোকসভা নির্বাচনে দলের ভুল রণকৌশলের দায় কারাট কেন নেবেন না? কিন্তু দলের অন্দরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সত্যিই তাঁর কোনও ভিন্ন মত থেকে থাকলে বুদ্ধবাবু পলিটব্যুরোয় গিয়ে কেন বলছেন না, তার কোনও ব্যাখ্যা কারাট-বিরোধী শিবিরের কাছেও নেই।
পার্টি কংগ্রেসের দলিল তৈরির কাজেই আগামী ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর দিল্লিতে ফের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি বসবে। সেখানে
বুদ্ধবাবু কী করবেন, তা ছাপিয়েও সিপিএমের অন্দরে এখন বড় প্রশ্ন কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে কি আর পলিটব্যুরোয় দেখা যাবে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দাকে? |