মাত্র এক বছরেই তিনি কাছের লোক হয়ে গিয়েছেন।
গলায় স্টেথো আছে, নামের আগে ডিগ্রি। কিন্তু এমনকী গাঁয়ের হাতুড়েদেরও যা হাঁকডাক আছে, তা তাঁর নেই। আছে শুধু গরিবগুরবো মানুষগুলোর প্রতি সমবেদনা।
বদলির ‘অর্ডার’ এসে গিয়েছে। কিন্তু কেউ তাঁকে যেতে দিতে রাজি নয়। বৃহস্পতিবার মঙ্গলকোটে লাখুরিয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কয়েকশো গ্রামবাসী। দাবি একটাই, চিকিৎসক সৌগত সরকারের বদলির আদেশ রদ করতে হবে। গত বছর জুলাইয়ে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মসূচি প্রকল্পে বর্ধমানের ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চুক্তিতে কাজে যোগ দিয়েছিলেন সৌগত। বর্ধমানেরই ইছলাবাদে তাঁর বাড়ি। সপ্তাহে চার দিন মোটরবাইকে চেপে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগে এসে হাজির হন তিনি। অনেক সময় মাঝরাস্তায় বাইক আটকেও ‘ডাক্তারবাবু’কে একটু দেখিয়ে নেন কেউ কেউ। তার পর বিকেল পর্যন্ত চলে টানা রোগী দেখা। |
লাখুরিয়ার এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে ওই গ্রাম ছাড়াও আশপাশের ১৬-১৭টি গ্রামের মানুষ নির্ভরশীল। পাশেই বীরভূমের নানুর থেকেও রোগীরা আসেন। তাঁদের অনেকের কাছেই সৌগত ‘ভগবান’। এঁদেরই কয়েক জনের কথায়, “অন্য ডাক্তারেরা যেখানে গরিব রোগীর গায়ে হাত দিতে অস্বস্তি বোধ করেন, উনি পচে যাওয়া জায়গাতেও হাত দিয়ে দেখেন।”
শুধু কি তা-ই? বর্ধমান বা কলকাতায় স্থানান্তরিত রোগীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়ে দেওয়া, প্রয়োজনে নিজের পকেটের টাকা দিতেও পিছপা হননি সৌগত। লাখুরিয়ার প্রণব দত্ত কৃতজ্ঞ, “আমার টাকা ছিল না। উনিই আমায় ওষুধ কিনতে ৫০০ টাকা দেন।” চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর মনে পড়ে, “আমার ছেলের হার্টের অসুখ। উনি শুধু টাকাই দেননি, চিকিৎসার জন্য নিজেই বেঙ্গালুরুতে যোগাযোগ করে দেন।” স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী কেশব সাধুও জানান, দুঃস্থ রোগীদের প্রায়ই নিজে ওষুধ কিনে দেন ডাক্তারবাবু।
এ হেন ডাক্তারকে কে-ই বা ছাড়তে চায়?
গত জুনে বর্ধমান ১ ব্লকে কুড়মুন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ রকমই এক চিকিৎসককে আটকানোর জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন গ্রামবাসী। সৌগতও যে বদলি হতে পারেন, আগাম সে আশঙ্কা করে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ও মঙ্গলকোট ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে সাড়ে তিনশো সই সংবলিত
চিঠি পাঠিয়েছিলেন এলাকার মানুষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাসখানেক আগে গলসি ২ ব্লকের আদ্রাহাটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সৌগতের বদলির নির্দেশ জারি করেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তন্ময় মুখোপাধ্যায়। বুধবার তা জানাজানি হয়।
লাখুরিয়ার যুবক অসিত চন্দ্র, বিপন মিরাটিদের কথায়, “বুধবার বিকেলেই আমরা গ্রামের রথতলায় বৈঠক করি। এ দিন সকাল ১০টা থেকে আশপাশের কোটালঘোষ, কল্যাণপুর ইত্যাদির পাশাপাশি নানুরের থুপসড়া, জাহানাবাদডাঙা থেকেও মানুষজন এসে বিক্ষোভে যোগ দেন।” ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সৌগত ছাড়া আরও চিকিৎসক আছেন। স্থানীয় বাসিন্দা নীলিমা কুণ্ডু, লক্ষ্মী দাস, হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক অরূপ গোস্বামীদের সাফ কথা, “আর যা-ই হোক, সৌগতবাবুকে সরানো চলবে না।”
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা অবশ্য এই দাবি মানতে নারাজ। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তন্ময়বাবু থেকে ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক বিশ্বজিৎ বিশ্বাসের একটাই কথা, “সরকারি নিয়ম বদলানো সম্ভব নয়।” সৌগত অবশ্য লাখুরিয়ার মানুষের আবেগ উপেক্ষা করতে পারছেন না। তাঁর কথায়, “এত সম্মান চাকরি জীবনে আর পাব বলে মনে হয় না। আমায় এখানে না রাখলে চুক্তিভঙ্গ করা ছাড়া হয়তো আর উপায় থাকবে না।” |