দুঃসহ দুর্ভোগ সয়ে নির্ধারিত সময়ের দশ ঘণ্টা পরে, বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটে নাগাদ উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস থেকে শিয়ালদহে নামলেন নব্বই বছরের অমিয়মাধব চক্রবর্তী। এতটাই ক্ষুব্ধ যে অসুস্থতা সত্ত্বেও হুইল চেয়ার ফিরিয়ে দিলেন তিনি। রেলের কোনও সাহায্যই তিনি আর নিতে চান না। ক্ষুব্ধ বৃদ্ধের বক্তব্য, “কোচবিহার থেকে আসতে গিয়ে যা কষ্ট পেয়েছি, তা বলার নয়। গোটা পথে রেলের কোনও সাহায্যই মেলেনি। এখন হুইল চেয়ার কী হবে!”
শুধু অমিয়মাধববাবুই নন, আটকে পড়া সব যাত্রীরই একই অভিজ্ঞতা। বুধবার রাতে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং মেলে উঠেছিলেন কলকাতার নাকতলার বাসিন্দা সৌমেন সরকার। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মৌমিতা ও ৪ বছরের মেয়ে আত্রেয়ী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিয়ালদহ পৌঁছে সৌমেনবাবু জানান, সারা রাত এনজেপি স্টেশনেই দাঁড়িয়েছিল ট্রেন। কামরায় আলো, পাখা চলেনি। সারা রাত এ ভাবে কাটানোর পর বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় রওনা দেয় ট্রেন। দার্জিলিং মেলের অনেক যাত্রীরই অভিযোগ, সারা রাত আলো-পাখা না চলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। এক মহিলা যাত্রী বলেন, “বুধবার রাতে খাবার মেলেনি। বাচ্চাদের নিয়ে বিস্কুট আর শুকনো খাবার খেয়ে কাটাতে হয়েছে।” যাত্রীদের আরও অভিযোগ, রেলের খাবার না মেলায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন হকাররা। একটি ডিমসেদ্ধও কিনতে হয়েছে কুড়ি টাকা দামে। একই ভোগান্তি হয়েছে জল কিনতে গিয়েও। এ দিন শিয়ালদহে পৌঁছনোর পরে অনেক যাত্রীই প্রশ্ন তুলেছেন, খোদ রেলমন্ত্রী যখন উত্তরবঙ্গে, তখন এই দুর্ভোগ পোহাতে হল কেন?
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তৈরির দাবিতে বুধবার সকাল থেকে বিহারের কিষাণগঞ্জে রেল ও ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ শুরু হয়। এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে গোটা দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিউ জলপাইগুড়িতে আটকা পড়েন খোদ রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। অবরোধের জেরে চূড়ান্ত হয়রান হয়েছেন ২২টি ট্রেনের প্রায় ২৫-৩০ হাজার রেল যাত্রী। রাস্তা অবরোধ হওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হয় আরও কয়েক হাজার যাত্রীকে। দূরপাল্লার সমস্ত বাস কিষাণগঞ্জ লাগোয়া এলাকায় আটকে পড়ে। |
অবরোধের জেরে আটকে পড়া রেলযাত্রীদের ধৈর্যের বাঁধ এক সময় ভেঙে যায়। আলুয়াবাড়ি-সহ বিভিন্ন স্টেশনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তাঁরা। বালুরঘাট-নিউ জলপাইগুড়ি ইন্টারসিটি বাতিল হওয়ার কথা ঘোষণা হওয়ায় একলাখি স্টেশনে ভাঙচুর হয়। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু কেন বারবার এমন বিপদে পড়বেন রেলের যাত্রীরা?
রেল কর্তৃপক্ষ এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। তাঁরা দায় চাপিয়ে দিয়েছেন বিহার সরকারের উপরে। রেলের কর্তাদের বক্তব্য, “আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। বিহারের গোলমাল হলে আমরা কী আর করতে পারি?” বিহার সরকারও এই ঘটনায় তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া
দেখায়নি। তবে কিষাণগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, পূর্ণিয়া ডিভিশনের কমিশনার ব্রজেশ মেরহোত্রা এসে আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেন। তিনি আন্দোলনকারীদের জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমি দিয়ে দেবে সরকার। এই আশ্বাস পাওয়ার পরেই অবরোধ উঠে যায়। তবে আন্দোলনকারীদের নেতা এবং কিষাণগঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ মৌলানা আসরারুল হক বলেছেন, “কমিশনারের আশ্বাস পেয়েই অবরোধ তুলে নিয়েছি। তবে এক মাসের মধ্যে রাজ্য সরকার আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি বরাদ্দ না করলে আমরা আমরণ অনশনে বসব।” কিন্তু ৫ ঘণ্টার অবরোধ করা হবে বলে আগেভাগে জানিয়েও কেন আন্দোলনকারীরা তা বাড়িয়ে ১৩ ঘণ্টা করলেন, তা নিয়ে ওই সাংসদ কোনও মন্তব্য করেননি।
রাতে অবরোধ উঠে যাওয়ার পরেও অবশ্য রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি। বুধবার রাতের দার্জিলিং মেল এবং পদাতিক এক্সপ্রেস এ দিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন ছাড়ে। রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, আজ, শুক্রবার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন প্রতিটি ট্রেনই গড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করেছে। ফিরতি পথে শুধু উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসই নয়, ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা দেরিতে শিয়ালদহে পৌঁছেছে দার্জিলিং মেল, কাঞ্চনকন্যা এবং তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসও। বৃহস্পতিবার সকালে কয়েক ঘণ্টা করে দেরিতে পৌঁছয় গৌড় এক্সপ্রেস-সহ আরও কয়েকটি ট্রেন। এই সব ক’টি ট্রেনেই কমবেশি দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। কেউ অভিযোগ করেছেন পর্যাপ্ত জল না মেলার, কেউ বা রেলের অসহযোগিতার দিকে আঙুল তুলেছেন। চা-শিল্প নিয়ে এ দিন কলকাতায় একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইউনিয়নগুলির প্রতিনিধিরা পৌঁছতে না পারায় ওই বৈঠকও পিছিয়ে গিয়েছে।
অবরোধের জেরে বৃহস্পতিবার শিয়ালদহ থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেনের ছাড়ার সময়ের বদল ঘটাতে হয়। বাতিল করা হয় হাটেবাজারে এক্সপ্রেস। রেল সূত্রে বলা হয়, বৃহস্পতিবারের হাটেবাজারে এক্সপ্রেস বাতিল হওয়ায় ওই ট্রেনের যাত্রীরা ভাড়া ফেরত পাবেন। তবে শুক্রবারের ট্রেনে যেতে গেলে ফের নতুন করে টিকিট কাটতে হবে ওই যাত্রীদের। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, অবরোধের কারণে ট্রেন বাতিল হলে যাত্রীরা কেন তার মাসুল দেবেন?
নিউ জলপাইগুড়ির তুলনায় এ দিন অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল শিলিগুড়ি জংশন ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাস। বুধবার রাতে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের তরফে একাধিক বাড়তি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাস থেকে যাত্রীদের চাহিদা মেনে আর মাত্র একটিই কলকাতাগামী বাড়তি বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। কলকাতার সমস্ত দূরপাল্লার বাস কয়েক ঘণ্টা দেরিতে হলেও নিরাপদে শিলিগুড়িতে পৌঁছেছে। |