সদ্য এক মাস হল, সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল দিল্লি হাইকোর্ট চত্বর। ১৫টি প্রাণ কেড়ে নেওয়া সেই ষড়যন্ত্রের আঁচও পাননি গোয়েন্দারা। তার রেশ কাটতে না-কাটতেই, দীপাবলির ঠিক আগে আবার বড়সড় বিস্ফোরণের ছক কষেছিল জঙ্গিরা, পুলিশ এ বার যা ভেস্তে দিল।
গত কাল হরিয়ানার অম্বালা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের বাইরে পাঁচ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক ভর্তি একটি গাড়ি আটক করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে পাঁচটা ডিটোনেটরও। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের দাবি: খাস রাজধানীর বুকেই ফের বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এবং পুলিশকর্তাদের মতে, নাশকতার এই চক্রান্তের পিছনে হাত রয়েছে জম্মু-কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তইবা ও শিখ জঙ্গি সংগঠন বব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল (বিকেআই)-এর।
বব্বর খালসার নাম বহু দিন বাদে প্রকাশ্যে এলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, এই গোষ্ঠী সম্পর্কে নানা তথ্য তাদের হাতে এসেছে। স্বরাষ্ট্র-সূত্রের খবর: আন্তর্জাতিক জঙ্গি-গোষ্ঠীটি নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের অর্থ জোগানের মূল উৎস কানাডা। দেশের অন্যত্র উপস্থিতি সে ভাবে জাহির না-করলেও জম্মু-কাশ্মীরে বব্বর খালসা যথেষ্ট সক্রিয়। সেখানে লস্কর তাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। লস্কর অবশ্য বরাবরই বব্বরকে মদত দিয়ে এসেছে।
আর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, বব্বর-লস্কর সমঝোতারই ফলশ্রুতি হল একটি নতুন সন্ত্রাস ব্যবস্থা (নিউ টেরর মডিউল)। অম্বালা-কাণ্ড তারই প্রমাণ। সেখানে বিস্ফোরকে ঠাসা পরিত্যক্ত গাড়িটা বিকেআই-কে দেওয়ার জন্য লস্করই পাঠিয়েছিল বলে মনে করছে পুলিশ। দিল্লি পুলিশের ডিসিপি (স্পেশ্যাল সেল) অরুণ কাম্পানির কথায়, “খবর এসেছিল, কাশ্মীরে লস্করের সমর্থনপুষ্ট একটা নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী দিল্লিতে হামলার ছক কষছে। তদন্ত নেমে আমরা জানতে পারি, বব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনালের জন্য বিস্ফোরক পাঠানো হয়েছিল। দিল্লিতে সেগুলো কাজে লাগানোর মতলবে ছিল তারা।”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করছে, এটাও লস্করের নতুন কৌশল। সন্ত্রাসরোধে ভারতের সঙ্গে থিম্পুর সার্বিক আলোচনা, কারজাইয়ের ভারত সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এমন বিবিধ অগ্রগতি বানচাল করতে চাইছে লস্কর। এবং নাশকতার মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্যসাধনে তারা নিজেদের আড়ালে রেখে এখন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন বা বব্বর খালসার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে। যাতে ভারতে জঙ্গি-হামলা হলে পাকিস্তানের দিকে সরাসরি আঙুল না-ওঠে। ৭ সেপ্টেম্বরে দিল্লি হাইকোর্টে ওই বিস্ফোরণের পিছনেও উঠে এসেছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের নাম। |
কী ভাবে ফাঁস হল নতুন বিস্ফোরণের ছক?
কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর: দিন দশেক আগে নেপাল থেকে আসা একটি ফোনে হরিয়ানা পুলিশ ইঙ্গিত পেয়েছিল, উত্তর ভারতের কোনও শহরে বিস্ফোরক নিয়ে আসা হচ্ছে। এর বেশি কিছু তখন জানা যায়নি। অবশেষে কয়েক দিন আগে দিল্লি পুলিশ জানতে পারে, বুধবার সন্ধ্যায় সেই বিস্ফোরক হাতবদল হবে অম্বালায়। তথ্যটি যাচাই করতে কাশ্মীরেও গিয়েছিল দিল্লি পুলিশের একটি দল। কোন গাড়িতে বিস্ফোরক আনা হবে, সে সম্পর্কেও খুঁটিনাটি তথ্য তাদের হাতে আসে।
এর পরেই হরিয়ানা পুলিশকে গোটা ব্যাপারটা জানানো হয়। দিল্লি ও হরিয়ানা পুলিশ গত কাল যৌথ তল্লাশিতে নামে। খবর আসে, গত কাল সকালেই সন্দেহভাজন একটি গাড়ি পাঠানকোটের লখনপুর টোল-সেতু পেরিয়েছে। পুলিশ তক্কে তক্কে ছিল। নজরদারি জোরদার করা হয়। কাল সন্ধেয় দিল্লির দু’শো কিলোমিটার দূরে অম্বালা স্টেশনের বাইরে পার্ক করা নীল রঙের গাড়িটি ধরা পড়ে সেই নজর-জালে। |
গাড়ির ভিতরে মিলেছে কালো রঙের ৫ কেজি বিস্ফোরক। সেগুলো তিনটে প্যাকেটে খয়েরি টেপ দিয়ে আটকানো ছিল। ছিল পাঁচটা ডিটোনেটর, দু’টো ব্যাটারিও একটা প্লাস্টিক বাক্সের মধ্যে। গাড়ির সামনের জানলার ফাঁকে লুকোনো ছিল দু’টো ‘এবিসিডি’ টাইমার। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও দু’টো টোল-সেতুর কাগজও পুলিশের হাতে এসেছে। গাড়ির মধ্যে ছিল এক বাক্স মিষ্টিও, যা জম্মু-কাশ্মীরের বারি ব্রাহ্মণ এলাকায় কেনা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। কাশ্মীরের দু’টো খবরের কাগজও গাড়িতে পাওয়া গিয়েছে। গাড়ি নম্বর প্লেটটি (এইচআর ০৩ ০০৫৪) ভুয়ো বলেই জানিয়েছে পুলিশ। সন্দেহ, হরিয়ানার কোনও গাড়ি থেকে চুরি করে তা লাগানো হয়েছে। কারণ, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কাগজে ওই নম্বরের উল্লেখ নেই। পুলিশের দাবি, গাড়ির মালিককে শিগগিরই খুঁজে বার করা হবে। তবে গাড়ির চালক বা অন্য কারও খোঁজ মেলেনি। পুলিশের ব্যাখ্যা, অম্বালা স্টেশনের বাইরে পুলিশ তল্লাশি চালাবে আন্দাজ করে জঙ্গিরা আগেই গা ঢাকা দেয়। সিসিটিভি ফুটেজে গাড়ির মধ্যে দু’জনকে দেখা গিয়েছে। তাদের হদিস পেতে পুলিশ স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। হরিয়ানা-পঞ্জাবে সতর্কতা জারি হয়েছে। |