শীত আসছে। এমন একটা শীতকালের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল দার্জিলিং পাহাড়। যে শীতকালে নেই কোনও গুমোট। পর্যটক থেকে পাহাড়বাসী, কারও মধ্যে নেই চকিতে সব কিছু মেপে নেওয়ার তাড়াহুড়ো। বরং কমবেশি সবেতেই যেন কিছুটা খুশির ছোঁয়া। নতুন-পুরনো সকলের মুখেই যেন আশার আলো।
মনগড়া বর্ণনা! মোটেই না।
প্রায় দু’দশক ধরে দার্জিলিং শহরের বাসিন্দা পরমা দাস কিংবা তিন পুরুষ ধরে কার্শিয়াঙে বসবাসকারী দে পরিবারের তিন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা এমনই মনে করছেন। অশীতিপর হলেও শেষ বয়সে নাতি-নাতনিদের জন্য ‘ভাল কিছু একটা হতে পারে’ ভেবে আশায় বুক বাঁধছেন রোহিণীর কালু তামাং ও তাঁর স্ত্রী দুর্গামায়াদেবীও। আবার দার্জিলিং সদরে প্রায় পাঁচ দশক ধরে থাকা ইকবাল আলম অথবা সন্তোষ তিওয়ারি, অজয় অগ্রবালরাও নিশ্চিন্তে ব্যবসাপাতি করতে পারবেন ভেবে পাট গোটানোর কথা ভুলে গিয়েছেন। |
ঘটনা হল, সুবাস ঘিসিংয়ের জমানার শেষ দিকে, মানে ২০০৩ সাল থেকেই পাহাড়ে কেমন একটা দমবন্ধ আবহাওয়ার সূত্রপাত। তখন ঘিসিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও কথা বললেই রোষের মুখে পড়ার আশঙ্কা। ঘিসিংকে হটিয়ে বিমল গুরুঙ্গ পাহাড়ে কর্তৃত্ব কায়েম করলেও সেই ভ্যাপসা-ভাবটা কিন্তু এত দিন কাটেনি। উল্টে, গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল-এর (জিএলপি) দাপটে সিঁটিয়ে থাকাই ভবিতব্য বলে মনে করেছিলেন অনেকে। ফলে, প্রায় ৫ বছর ধরে পাহাড়ে শীত এসেছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝলমলিয়ে উঠেছে, কিন্তু গুমোট ভাবটা কাটেনি। তাই অনেকেই দার্জিলিং থেকে পাট চোকানোর কথা ভাবতে শুরু করেন। এমনকী, গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পরেও দমবন্ধ করে দেওয়া জুলুমবাজির হাত থেকে রেহাই মিলবে কি না, তা নিয়েও ছিল নানা জল্পনা।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে চার মাসের মধ্যে তিন বার দার্জিলিং পাহাড়বাসীদের সামনে পৌঁছে ‘মিলেমিশে থাকা’র উপরে বারেবারে জোর দেওয়ায় সেই গুমোট ভাবটা কেটেছে বলে মনে করছেন পরমাদেবীরা। নৃত্যশিল্পী পরমাদেবী বললেন, “শীত মানেই পাহাড়ে উৎসবের মেজাজ। কিন্তু এত দিন কেমন একটা দমবন্ধ করা ব্যাপার অনুভব করতাম। অনেক দিন পরে এ বার ২২ শ্রাবণে মংপুতে নেপালি ভাইবোনেদের সঙ্গে মিলেমিশে অনুষ্ঠান করেছি। পাহাড়ের অন্যতম গায়িকা হীরা রসৌলি নেপালিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছেন। দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) যে ভাবে ঘন ঘন পাহাড়ে যাতায়াত করছেন, তাতে দার্জিলিঙের পুরনো ছন্দে ফিরতে খুব দেরি হওয়ার কথা নয়।” |
কার্শিয়াঙের ডাউহিল রোডের বাসিন্দা অলকা দে-র বয়স এখন ৭৩। পাহাড়ই ধ্যানজ্ঞান তাঁর। অলকাদেবীরা এ বার রাজরাজেশ্বরী হলে জমিয়ে দুর্গাপুজো করেছেন। নবমীতে পাত পেড়ে খাওয়ার দিনে রেকর্ড ভিড়ও হয়েছে। পুজোর আয়োজন নিয়ে খোঁজখবর করেছেন স্থানীয় নেপালিভাষীরাও। অনেকের বাড়িতে চাঁদা চাইতে যাওয়া হয়নি বলে কিছুটা অভিমানের সুরে দু’কথা শুনিয়ে নিজেরাই ক্লাবে গিয়ে তা পৌঁছে দিয়েছেন। অলকাদেবীর কথায়, “উনি (মমতা) যে ভাবে পাহাড়কে চেনা ছন্দে ফেরাতে চাইছেন, তাতে কাজ হচ্ছে। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, চাকরি-বাকরি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। এটা উনি করবেনই। আমার যেটা উপলব্ধি, তা হল পাহাড়ে সম্প্রীতির পরিবেশটা ফেরানোর ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর বারবার আসাটা কাজে দিচ্ছে।”
যেমন? |
অলকাদেবী জানালেন, কার্শিয়াঙের ব্লুমফিল্ড লাইব্রেরির ঘরে জিএলপি ক্যাম্প হয়ে গিয়েছিল। বহু বার অনেককে বলেও কাজ হয়নি। সিংমারিতে এক অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন লাইব্রেরির সভাপতি অলকাদেবী। সেখানে বিমল গুরুঙ্গ একটি অনাথ আশ্রম তৈরি করছেন। তা ঘুরিয়ে দেখিয়ে পরামর্শ নিচ্ছিলেন অলকাদেবীর কাছ থেকে। সেই সময়ে অলকাদেবী তাঁকে লাইব্রেরিতে জিএলপি ক্যাম্প থাকার কথা বলায় গুরুঙ্গ চমকে যান। অলকাদেবী বলেন, “বিমল শুনে খুব ক্ষেপে গেল। ওঁকে না জানিয়ে লাইব্রেরিতে জিএলপি রাখা হয়েছে কেন সেটা সহকর্মীদের কাছে জানতে চাইল। তা পর দিনই সরিয়ে নিতে বলে দিল। এমনকী, আর পাঁচ জন নেতার সামনে বিমল আমাকে বলল, ‘এর পরে আমি চাইলেও যেন ওই লাইব্রেরি না পাই। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনও কাজে লাইব্রেরি ব্যবহার করতে দেবেন না।”
বস্তুত, ঘিসিংয়ের সঙ্গে এটাই ফারাক গুরুঙ্গের। অন্তত জিএনএলএফের ‘বসে যাওয়া’ নেতাদের কয়েক জন তাই-ই মনে করছেন। তাঁদের কথায়, “আমাদের নেতার (ঘিসিং) সুরক্ষা বলয় এমন ছিল যে কাছেপিঠে যাওয়া মুশকিল ছিল। বিমল গুরুঙ্গ তো এখনও নিজে হুটহাট বাড়ি-বাড়ি ঢুকে খোঁজখবর নেয় শুনেছি। দলের লোকরা অন্যায় করলে ছাড়ে না। দেখা যাক এটা কত দিন ধরে রাখতে পারে!” |
‘দিদি-দিদি’ আওয়াজের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে নেপালি গানের সুর। মেলবন্ধনের ছন্দে ফিরছে পাহাড়।
এমন সময়ে ঘিসিং কোথায়? না, জলপাইগুড়ির ভাড়া বাড়িতে নয়। ঘিসিং এখন শিলংয়ে। গত বৃহস্পতিবারই শিলংয়ের পুলিশ বাজারের ভিড় থেকে একটু দূরে উদাস ভাবে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে বেড়াতে যাওয়া শিক্ষক সঞ্জয় রক্ষিতের মতো অনেকেই তাঁকে চিনতে পেরে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাজ্যপাট না থাকলেও পুরনো অভ্যেস রয়েই গিয়েছে তাঁর। পকেট থেকে চকলেট বার করে বিলিয়ে দিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। দার্জিলিং নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি। এই মুহূর্তে কিইবা বলার থাকতে পারে ঘিসিংয়ের! |