শান্তি বজায় রাখব, ‘কৃতজ্ঞ’ গুরুঙ্গের আশ্বাস মমতাকে
তিনি রাজনীতি করতে আসেননি। নিজেই বললেন।
নিজেই বললেন, এসেছেন পাহাড়ে উন্নয়নের দৌড় শুরু করতে এবং ইতিমধ্যেই সৃষ্ট শান্তির বাতাবরণ আরও দৃঢ় করতে।
কিন্তু তিনি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবারের ভিড়ে ঠাসা দার্জিলিং ম্যালে একই সঙ্গে গূঢ় রাজনৈতিক বার্তাও দিয়ে গেলেন দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ছিল। আছে। থাকবে।
গুটিকয়েক নমুনা দিই?
এক, “যত দিন জীবন থাকবে, আপনাদের জন্য জান কুরবান। দার্জিলিংকে আমরা ছাড়ব না।”
দুই, “মহব্বত দিল সে হোতা হ্যায়, ঝগড়া করনে সে নহি।”
তিন, “উই উইল ওয়র্ক লাইক আ জয়েন্ট ফ্যামিলি। উই উইল টেক কালেকটিভ ডিসিশন্স।”
চার, “আমরা চাই মিলেমিশে কাজ করতে। আপনারা আমায় কাজ করতে দিন। আপনাদের সাহায্য নিয়েই আমি কাজ করব। আমি পাহাড়কে ভালবাসি। জানি, পাহাড়ের মানুষকে ভালবাসলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে না।”
পাঁচ, “আমি রাজনীতির কথা বলতে আসিনি। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার মাসে এই জেলায় এই নিয়ে তিন বার এলাম। আরও আসব।”
পথেই মিলল নতুন বন্ধু। মঙ্গলবার দার্জিলিঙে হাল্কা মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী।
এর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সত্যিই কোথাওই গুরুপাক রাজনীতির কথা নেই। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, রয়েছে রাজ্যের প্রধান ‘প্রশাসক’ হিসেবে অত্যন্ত নির্ভুল সঙ্কেত। যে সঙ্কেত গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে দার্জিলিংয়ে এসে প্রথম দিয়ে গিয়েছিলেন মমতা আলাদা রাজ্য-টাজ্য চলবে না। দার্জিলিং এ রাজ্যেরই অংশ।
আনুষ্ঠানিক ভাবে এ দিন ম্যালের পর্যটন উৎসবের উদ্বোধন করলেন মমতা। গাড়ি থেকে নেমে মূল অনুষ্ঠান-মঞ্চ পর্যন্ত তিনি এলেন পায়ে হেঁটে। সামনে-পিছনে অগণিত জনতা এবং নেপালি ঐতিহ্যপূর্ণ গীতবাদ্য শিল্পীরা। দু’পাশে পাহাড়ের উঁচু ধাপ থেকে তাঁর মাথায় ঝরে পড়ছে ফুল, তাঁর জোড়হাতে নমস্কারের ছবি খচাখচ উঠছে নেপালি তরুণ-তরুণীর ডিজিটাল ক্যামেরায়। ঢেউয়ের মতো ধেয়ে আসছেন মানুষ। তাঁরা সকলেই মমতাকে ছুঁতে চান। অন্তত এক বার কাছ থেকে দেখতে চান। মঞ্চের পাদদেশ থেকে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেলেন মোর্চার অন্যতম নেতা রোশন গিরি। যিনি কিছু পরে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলবেন, “মমতা ম্যাডামের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। সিকিমে আগত কেন্দ্রীয় দলের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি দার্জিলিংয়ের জন্য সাহায্য চেয়েছেন।”
পাহাড়ের জন্য যে ঢালাও উন্নয়নের প্যাকেজ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঘোষণা করলেন (তার মধ্যে জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের হাতে মঞ্চেই দু’টি স্কুলের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার চেক দিয়ে দেওয়া), তার কথা ছেড়েই দিন! চালু নেপালি বাক্যে জনতাকে কুশল প্রশ্ন দিয়ে বক্তৃতা শুরু করে (যেটা যে কোনও গণনেতা বা নেত্রীর কাছেই আবশ্যিক এবং নিশ্চিত আঞ্চলিক জনমনোহরণী টোটকা) দ্রুত হিন্দি-বাংলা-ইংরেজিতে চলে যাওয়া, সামনে বসা জনতার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার ভঙ্গিতে প্রশ্নোত্তর, তাদের প্রশ্ন করে (‘আর কিছু চাই? আমাদের সঙ্গে থাকবেন তো?’ ইত্যাদি) সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ গর্জন করিয়ে নেওয়া, অনবরত পাহাড়ের বাসিন্দাদের ‘ভাইবোন’ সম্বোধন করা, অনুষ্ঠানের শেষে নিরাপত্তার ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে পড়া জনতার বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসের মধ্যে সমতলে পরিচিত ‘মমতা-ম্যাজিক’ ছড়িয়ে গেল দার্জিলিংয়েও।
এর পর কেন্দ্রীয় সরকারের রেল দফতর এবং রাজ্য সরকারের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান শেষে মুখ্যমন্ত্রী দর্শকাসনে সটান বসে পড়লেন সঙ্গী রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব এবং কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। নেপালি ভাষায় সঙ্গীতানুষ্ঠান শুনতে (যে সাংস্কৃতিক টিমের জন্য রেল এবং রাজ্যের তরফে পাঁচ-পাঁচ করে মোট ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী)। এবং পরিচিতের মোবাইলে এসএমএস এল, “ইজ ইট ওকে?”
ঈষৎ উচাটন মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো গেল, অনুষ্ঠানের শেষ পাতের জন্য তিনি তুলে রেখেছিলেন তাঁর তূণীরের ব্রহ্মাস্ত্র। যা গোটা ম্যালকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কী? না, খালি গলায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাইকের সামনে ‘জনগণমন’ গাইছেন আর তাঁর সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গলা মেলাচ্ছেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুঙ্গ এবং তাঁরা স্ত্রী আশা গুরুঙ্গ। ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট জাতীয় সঙ্গীতের সুরে সকলকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলা।
চায়ের আসরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিমল গুরুঙ্গ। মঙ্গলবার দার্জিলিঙে।
যখন মমতা বলেছেন, “দার্জিলিং পাহাড়ের ভাইবোনেরা আমাদের পুলিশবাহিনীতে চাকরি করবেন”, হাততালির ঝড় উঠেছে। যখন বলেছেন, “বাংলার মাটি বাংলার জল পুণ্য হউক, হে ভগবান”, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে জনতা। যখন বলেছেন, “সকালে লেপচারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমি তাঁদের বলেছি, আমাদের সরকার লেপচাদের জন্য উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করবে। দার্জিলিঙেই হবে তার সদর দফতর”, ম্যালের ভিড় হর্ষধ্বনি করেছে। যখন বলেছেন, “আমি জানি দার্জিলিঙের রাস্তার হাল খুব খারাপ। ভূমিকম্পের পর তা আরও খারাপ হয়েছে। আমি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ দিন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাঁদের বলেছি, যে ভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য ৯০ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা দার্জিলিঙের জন্যও দেওয়া হোক”, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে জনতা।
বস্তুত, এ দিন সকাল থেকেই রিচমন্ড হিল-এ একের পর এক বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন পাহাড়ের লেপচা জনজাতির মানুষ, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মচারী এবং শহরের বিভিন্ন স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মমতা তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করেছেন। মন দিয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনেছেন। ফিরে যাওয়ার সময় তাঁরা বলেছেন, এর আগে কোনও মুখ্যমন্ত্রী এত মন দিয়ে তাঁদের কথা শোনেননি।
এবং বিমল গুরুঙ্গ স্বয়ং!
অনুষ্ঠানের শেষে মোর্চা-প্রধান যে বক্তৃতা দিলেন, তাতে মমতার জন্য ‘মমতা’ ঝরে ঝরে পড়েছে। আর বিগত বাম সরকারের জন্য তীব্র শ্লেষ, “চুয়াল্লিশ মাস ধরে আমরা জন-আন্দোলন করেছি পাহাড়ে। অনেক বার সিপিএম সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা বসতে চায়নি। দিদি আমাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে আমাদের সমস্যা শুনেছেন। আমাদের ব্যথা বোঝার চেষ্টা করেছেন।” আরও এক ধাপ এগিয়ে, “আগের সরকারের মুখ চলত। মন চলত না। এই নতুন সরকার হৃদয় দিয়ে কথা বলছে। আমরা ম্যাডামের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি ওঁকে কথা দিচ্ছি, আমরা দার্জিলিঙে শান্তি বজায় রাখব। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করছেন। আমরা সব সময় তাঁর পাশে আছি এবং থাকব।”
এ দিন সকালেই ঘরোয়া আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী বলছিলেন, “আমি কিন্তু পাহাড়-চুক্তি সই হওয়ার পরেই দার্জিলিঙে এসেছি। আমি কি কখনও কোথাও গোর্খাল্যান্ড দেওয়ার কথা বলেছি?” আর প্রকাশ্য বক্তৃতায় বললেন, “আমরা জিটিএ চুক্তি সই হওয়ার পর কিন্তু কাজও শুরু করে দিয়েছি।” যা শুনে হাততালি দিল জনতা। তালি দিলেন মোর্চা নেতারাও।
মঙ্গলবার মংপুতে মুখ্যমন্ত্রী।
একটা অনুযোগ অবশ্য রইল গুরুঙ্গের তরফে। যাতে কিঞ্চিৎ ‘বিপন্ন’ হতে পারেন বনমন্ত্রী হিতেন বর্মণ। দার্জিলিং আপাতত থিকথিক করছে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে। তাঁদের সঙ্গেই রয়েছেন কপালে টিকা পরা অসংখ্য গোর্খা জনজাতির মানুষ। পাহাড়ে এখন ‘টিকাদান’ উৎসব চলছে। তাঁদের সামনেই বিমল বললেন, “একটা অনুরোধ আছে। কথা ছিল, বনমন্ত্রী দার্জিলিঙে এসে রোপওয়ে চালু করবেন। কিন্তু উনি আর এলেন না! রোপওয়েটা চালু হলে আমরা আরও পর্যটক টানতে পারব। পাহাড়ের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বলছেন, হিতেনবাবুর কাছে ‘জরুরি ফোন’ গেল বলে!
বিমল আরও বললেন, “দিদি কথা রেখেছেন। জিটিএ চুক্তি করেছেন। আমাদের কথা বুঝেছেন। গোর্খা যুবক-যুবতীদের পুলিশে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কথা দিচ্ছি, আমরা তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব।”
এই পর্যন্ত বললেও চলত।
কিন্তু বিমল আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। এবং যা বললেন, তাতে পাহাড়ে তৃণমূলের শাখা খোলার জন্য উৎসাহিত হতে পারেন সংগঠনের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত মুকুলবাবু।
সেটা অবশ্য নিছকই রসিকতা করে লিখলাম। কিন্তু গোটা ম্যাল শুনল এবং ইথার-বাহিত হয়ে গোটা পাহাড়ে ছড়িয়েও গেল যে, বিমল বললেন, “দার্জিলিঙের কোনও উন্নয়ন হলে তার জন্য আগে মমতাদিদির নাম আসবে! আগে তাঁর অবদানের কথা মানুষ মনে রাখবে। তার পর আমাদের কথা মনে করবে লোকে!”
এতটা সম্ভবত আশা করেননি মমতাও। কিন্তু হলে মন্দ কী?
পাহাড় প্যাকেজ
পর্যটনের জন্য মাস্টার প্ল্যান।
কালিম্পং, সুকিয়াপোখরিতে দু’টি মডেল স্কুল।
রবীন্দ্রনাথ ও ভানুভক্তের নামে অ্যাকাডেমি।
১৭টি প্রাথমিক, ৩০টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল। ৫৫টি স্কুলের মানোন্নয়ন।
২ বছরের মধ্যে সব স্কুলে পানীয় জল। সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে কম্পিউটার, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি।
দার্জিলিং পুর এলাকার জন্য বালাসন পাম্পিং স্টেশন।
লেবং স্টেডিয়ামের জন্য ৩ কোটি টাকা।
ম্যালের সৌন্দর্যায়নে ১০ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক পার্কিং সেন্টারের জন্য ২৮ কোটি টাকা।
লেপচা উন্নয়ন পর্যদ গঠন।
পুলিশে চাকরির বিশেষ প্রকল্প।
ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত রাস্তা মেরামত ও পানীয় জল ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য ২০ কোটি টাকা।
মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দু’টি স্কুলের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা।
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে দার্জিলিঙের জন্য ৪৯৫ কোটি টাকা চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি।
সন্ধেতেই দার্জিলিং ছেড়ে রাতে ডুয়ার্সে ঢুকে পড়েছেন মমতা। আসার পথে টুক করে ঘুরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-বিজড়িত মংপু। মালা দিয়ে এসেছেন বিশ্বকবির মূর্তিতে। ম্যাল পেরিয়ে চালসায় যখন ঢুকছে তাঁর কনভয়, লক্ষ্মীপুজোর দিন তাঁকে ঘিরে জনতা আওয়াজ তুলেছে ‘মা-লক্ষ্মী মা-লক্ষ্মী’। আজ, বুধবার মালবাজারে সরকারি অনুষ্ঠান এবং সভা মুখ্যমন্ত্রীর। তার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন আদিবাসী বিকাশ পরিষদের নেতারা। পাহাড় তাঁকে নিরাশ করেনি। আগামী দু’দিনে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে জয় করার জন্য পড়ে রইল ডুয়ার্সের ঈষৎ ‘জটিল’ সমতলভূমি।

ছবি: অশোক মজুমদার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.