এক বার নীতীশ বলছেন, “এর আগে আডবাণীজি অনেক যাত্রা করেছেন। কিন্তু এটা হল বিশুদ্ধ দুর্নীতি-বিরোধী যাত্রা। এই যাত্রা সমাজকে জোড়ার, ভাঙার জন্য নয়। এই যাত্রা ওঁর বিহার থেকে শুরু করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।”
আবার পরক্ষণেই বলছেন, “কেন জানি না, কিছু লোক যাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে কত কথা বলছেন। আমাকে ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ পড়াতে শুরু করেছেন। ওঁরা নিজেরাই এখন তন্ত্র-মন্ত্রে বেশি বিশ্বাস করেন! তাই, আমি সূর্যগ্রহণের সময়ে বিস্কুট খেলে সমালোচনা করেন। তন্ত্র দিয়েই যদি শাসন চলত, তা হলে তো কোনও তান্ত্রিকই সবচেয়ে ভাল মুখ্যমন্ত্রী হতেন!”
একটু থেমে আবার বলছেন, “আমার একমাত্র লক্ষ্যই হল উন্নয়ন। হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী-দলিত, সবার উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই আমি কাজ করে চলেছি।”
মঞ্চটা ছিল লালকৃষ্ণ আডবাণীর জন চেতনা যাত্রার। কিন্তু সেই মঞ্চকে ব্যবহার করে নীতীশ সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে নিজেকে এনডিএ-র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা এ ভাবেই অনেকটা সেরে রাখলেন। সে কারণেই তিনি সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সাফাই দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ফিরিস্তি দিয়েছেন তাঁর সরকারের দুর্নীতি-বিরোধী অবস্থান এবং তাঁর সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের। |
এনডিএ জোটের তরফে পরবর্তী নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। রথযাত্রা করে নিজেকে সেই পদের ‘যোগ্য’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেও সঙ্ঘ আডবাণীকে মানতে এখনও নারাজ। তা হলে কে? সেই প্রশ্ন উঠছেই। এর মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষ এবং উন্নয়নকারী শাসক হিসেবে নীতীশ কুমার সর্বভারতীয় স্তরে নিজের একটি পৃথক ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছেন। নীতীশ ভালই জানেন, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে কোনও আঞ্চলিক স্তরের নেতাকে যদি প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী করার কথা আলোচনায় ওঠে, তা হলে এনডিএ জোটের মধ্যে অন্য যে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর তুলনায় তাঁকে মেনে নেওয়া বিজেপি-র পক্ষে অনেক সহজ। আর সেই অঙ্কেই আডবাণীর রথযাত্রাকে হাতিয়ার করে নিজেকে তুলে ধরার একটা চেষ্টা চালিয়ে গেলেন নীতীশ।
নীতীশের এই চেষ্টা পোড়খাওয়া নেতা লালুর চোখ এড়িয়ে যায়নি। এক সময় আডবাণীর রামরথ বিহারে আটকে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বিহারবাসীর ‘মসিহা’। সে কথা মাথায় রেখেই আডবাণীর রথযাত্রার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন তিনি। আজ তাঁর দল আরজেডি-র ডাকা ‘রাজভবন চলো’ অভিযানে অংশ নিয়ে লালু আজ নীতীশকে রীতিমতো কটাক্ষ করে বলেন, “নীতীশ ভাবছেন, আরএসএসের কোলে বসে প্রধানমন্ত্রী হবেন! সে গুড়ে বালি। সঙ্ঘ কখনওই ওঁকে প্রধানমন্ত্রী বানাবে না।” |
লালু যা-ই বলুন, নীতীশের লক্ষ্য কিন্তু স্থির। সে কারণেই আজ তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণের জন্মস্থান সিতাবদিয়ারা এবং ছাপরা, দু’জায়গাতেই নিজের কাজকর্মের কথা ফলাও করে তুলে ধরেছেন। তাঁর কথায়, “স্বচ্ছ প্রশাসন না হলে সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই ২০০৯ সালে আমি দুর্নীতি রুখতে বিশেষ আইন এনেছি। কিন্তু কেন্দ্র তাতে সিলমোহর দিতে ১০ মাস সময় নিয়েছে! ওই আইনের বলে সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারদের বেআইনি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।” নীতীশ বলেন, “২০০৯ সালে বিকাশ যাত্রায় গিয়ে রাজ্যের মানুষের কাছ থেকে আমি ভুরি ভুরি দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছিলাম। তখনই বুঝতে পারি, দুর্নীতি রুখতে পদক্ষেপ না করলে কোনও উন্নয়নই সম্ভব নয়। আমি খুশি, ইতিমধ্যেই দুর্নীতিগ্রস্ত এক অফিসারের বেআইনি সম্পত্তিতে মুসহরদের স্কুল খোলা হয়েছে। তবে এখানও লড়াই শেষ হয়নি। এমন স্কুল আরও খোলা হবে।” স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের ফি বছর সম্পত্তি ঘোষণার উদাহরণও এ দিন তুলে ধরেন নীতীশ।
এখানেই শেষ নয়। যে ‘সুশাসনে’র কথা বলে বিজেপি নাগাড়ে কেন্দ্রে প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে বিঁধে চলেছে, সেই সুশাসনই যে তাঁর সরকারের মূল লক্ষ্য, তা-ও এ দিন বারবার জানিয়েছেন তিনি।
আজ দিনভর বিজেপি-র নেতাদের মুখেও ছিল ‘নীতীশ প্রশস্তি’। আর সেটা করতে গিয়ে লালু প্রসাদ যাদবকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি তাঁরা। রাজনীতিতে এই মুহূর্তে নীতীশের ‘চরম’ শত্রু বলে পরিচিত গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও নিজের ব্লগে লালুকে নিশানা করেছেন আজ। মোদীর সুরেই নীতীশের প্রশংসা করে বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজও বলেন, “জয়প্রকাশ নারায়ণের এক শিষ্য বিহারকে বরবাদ করে ছেড়ে দিলেন! আর তাঁর অন্য দুই পরম শিষ্য নীতীশ-মোদী এখন বিহারকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।” |