|
|
|
|
|
|
|
বিপুল নিকট |
সমরেশ মজুমদার |
জোরে ব্রেক চাপল অজয়। বাইপাসের রাস্তা ছেড়ে তার গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সে অনেকটা ঘুরে বসে বলল, ‘আপনাকে আমি চিনব কী করে? ওই মেয়েটাকে যখন গাড়িতে তুলেছিলাম আপনি সেই সুযোগে উঠে বসেছেন। খুব অন্যায় করেছেন। নেমে যান।’
‘তুমি এখনও ভুল করছ হে। যা বৃষ্টি, ওই ভাবে উঠলে তো আমার শরীর জলে ভিজে যেত।’
মানুষটির হাসি দেখে খেয়াল হল অজয়ের। সত্যি তো, এক ফোঁটা জলের দাগও ওঁর পোশাকে নেই।
‘কিন্তু তুমি খুব ভাল কাজ করেছ। নইলে ওই মেয়েটি কোনও গাড়ির নীচে চাপা পড়ত অথবা ওই মাতালদের লালসার শিকার হত। এই তো চাই! কে বলে, আজকাল মানুষের বুক থেকে দয়া-মায়া-পরোপকার করার ইচ্ছে চলে গেছে!’
অজয় মানুষটিকে ভাল করে দেখল। এ বার মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছে ওঁকে। আর তার পরেই মনে হতে লাগল, খুব চেনা ওই মুখটা। সে নিজের মনেই বলল, ‘না, এ হতে পারে না।’
‘কী হতে পারে না?’
‘অসম্ভব!’ মাথা নাড়ল অজয়।
‘আহা, তুমি তো মূর্খ নও যে অসম্ভব বলবে।’
‘দেখুন, আপনার সঙ্গে যে মানুষটির হুবহু মিল, তিনি কত বছর আগে জানি না, মাইকেল মধুসূদন দত্তের আমলে বেঁচে ছিলেন। সেই মানুষটি এত বছর বাদে আমার গাড়িতে বসে থাকতে পারেন না!’
‘কেন পারে না! কচি কচি শিশুরা যখন বইটা তাদের নরম হাতে স্পর্শ করে তখনই আমি বেঁচে উঠি। এই পৃথিবীর বাতাস থেকে তারাই মুছে যায়, যারা বেঁচে থাকার সময় মানুষের জন্যে একটুও ভাবেনি।’ তিনি হাসলেন।
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তা হলে কি যাঁদের কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, তাঁরা সবাই এখানে বাতাসের সঙ্গে মিশে আছেন?’
‘হ্যা।ঁ আছেন।’ তিনি মাথা দোলালেন, ‘কিন্তু তুমি বেশ ভাল ভাবে কথা বলতে পারো, অন্যান্য ট্যাক্সিচালকদের মতো নয়।’
‘আমি গাঁয়ের ছেলে। বি এ পাশ করে কোনও কাজ না পেয়ে ড্রাইভিং শিখে কলকাতায় ট্যাক্সি চালাচ্ছি।’
‘খুব ভাল করেছ। কোনও কাজই ছোট নয়, যদি কাজটা ভাল ভাবে করো। তা এখন ওই মেয়েটিকে নিয়ে কী করবে?’
‘বুঝতে পারছি না। হাসপাতালে নিয়ে গেলে পুলিশ ধরবেই।’
‘তাই বলে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে যাওয়া অত্যন্ত অন্যায় হবে।’
অজয় লজ্জা পেল, ‘আমার মাথা কাজ করছিল না...!’
|
|
‘আমি বলি কী, মেয়েটিকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়াই ভাল। মনে হয় ওর শরীরে কোনও আঘাত লাগেনি, ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।’ ‘কিন্তু আমি তো ওর বাড়ি কোথায় তা জানি না।’ অজয় রাস্তার দিকে তাকাল। বৃষ্টি কমে আসছে। গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। সে বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই ওর বাড়ির ঠিকানা বলতে পারবেন।’
কোনও সাড়া নেই। অজয় দেখল মানুষটি নেই। মেয়েটি নড়ে উঠে অস্ফুট আওয়াজ করল, ‘উঃ’।
অজয় চিৎকার করল, ‘আপনি চলে গেলেন কেন?’ নিজের কাছেই গলাটাকে অপরিচিত ঠেকল তার।
নিজের শরীরে চিমটি কাটল অজয়। সে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খামোকা তার গাড়িতে এসে বসবেন কেন? মাল খেয়ে ওঁকে দেখলে কিছু বলার ছিল না। সেই কবে ‘বর্ণপরিচয়’-এর পাতায় ওঁর মুখ প্রথম দেখেছিল, কলেজ স্কোয়ারের মূর্তিটা তো আজকাল আড়ালে পড়ে যাওয়ায় চোখে পড়ে না, কিন্তু কেসটা মুন্নাভাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে না?
গাড়ি চালিয়ে অনেকটা এগোতেই মোবাইল বেজে উঠল। অন করতেই সে মালিকের গলা শুনতে পেল, ‘কী ব্যাপার? এখন কোথায়?’ ‘এসে গেছি।’ অর্ধসত্য বলল সে। ‘নাহে, আজ রাতের ডিউটি করতে পারবে না ধনঞ্জয়। বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছে। এখানে গ্যারেজের সামনেও হাঁটুজল জমে গেছে। জল নামলে গ্যারাজ করে চাবি দিয়ে যেয়ো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’ মালিক বলল। ‘যা ব্বাবা। রাস্তায় কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। আমি ততক্ষণ কোথায় ঘুরব?’ ‘তোমার বাড়ির সামনে জল জমে?’ ‘বোধ হয় না।’ ‘তা হলে রাতে ওখানেই রেখে গাড়ির মধ্যে শুয়ে থেকো।’
গাড়ির মধ্যে সারা রাত শুয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তার আগে এই মেয়েটার হিল্লে করা দরকার। সে চার নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে এসে গাড়ি থামাল, ‘এই যে, শুনছেন? বিদ্যাসাগরমশাই যা-ই বলুন, এতক্ষণে তো জেগে ওঠা উচিত?’
মেয়েটির মুখ থেকে একটু আওয়াজও বের হল না। অজয় জলের বোতল থেকে খানিকটা মেয়েটির মুখে ছুড়ে মারতেই কথা ফুটল, ‘ওঃ, ও মা! মাগো।’ |
‘আপনার মায়ের ঠিকানাটা দয়া করে বলুন।’
‘অ্যাঁ! আমি, আমি কোথায়?’
‘আমার ট্যাক্সিতে। রাস্তায় পড়েছিলেন, দয়া করে গাড়িতে তুলে বাঁচিয়েছি। আমার কথা বুঝতে পারছেন? এখন দয়া করে নেমে যান। সাউথে বাড়ি হলে বলুন পৌঁছে দিচ্ছি। তিনি বলে গিয়েছেন আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।’
‘কে?’ ‘নাম বললে আমাকে পাগল ভাববেন। কোথায় থাকেন?’
‘হটর।’
‘সেটা কোথায়?’
‘দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। স্টেশন থেকে বাসে যেতে হয়।’
‘ও। পার্ক সার্কাসের মোড়ে নামিয়ে দিচ্ছি, শেয়ালদায় গিয়ে ট্রেন ধরুন।’
‘আমার মাথা ঘুরছে, হাঁটতে পারব না।’ মেয়েটি এ বার কেঁদে ফেলল।
অজয় দেখল দূরে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার ইঞ্জিন চালু করে বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়ল, ‘সল্ট লেকে কী করছিলেন?’
‘আমাকে চাকরি দেবে বলে ডেকেছিল।’
‘কী ভাবে ডাকল?’
‘কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছিলাম।’
‘তো?’
‘এতক্ষণ বসিয়ে রেখে বলল, আমার চাকরি হয়ে যাবে। ওদের কোম্পানিতে টাকা দিয়ে যারা কিছুক্ষণের জন্যে বান্ধবী চায় তাদের সঙ্গ দিতে হবে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না দেখে মেয়েটা আমাকে ওদের মালিকদের ঘরে নিয়ে গেল। তারা তখন মদ খাচ্ছিল। বলল, ‘ঠিক আছে, চাকরি করতে হবে না। খুব বৃষ্টি পড়ছে, চলো তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’ গাড়ির মধ্যে ওরা আমার গায়ে হাত দিতেই আমি ধাক্কা মারতেই গাড়ি রাস্তার ধারে চলে গিয়ে চাকায় আওয়াজ তুলে থেমে যায়। আমি তখন দরজা খুলে দৌড়তে থাকি। ওঃ, আর কিছু মনে নেই।’
‘বাঃ, চমৎকার গল্প!’ অজয় হাসল।
‘না।’ চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটি, ‘গল্প নয়। সত্যি।’
‘বেশ। এখন আপনি কোথায় যাবেন? কলকাতায় কোনও আত্মীয় আছেন?’
‘না। কেউ নেই।’
বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছিল। অজয় মাথা নাড়ল, ‘আপনাকে আমি চিনি না, এমনকী আপনার নামও জানি না। পুলিশ ধরলে ফেঁসে যেতে হবে। দয়া করে আমাকে বাঁচান, নেমে পড়ুন।’ |
‘আপনি, আপনি আজ রাতটা আপনার বাড়িতে থাকতে দেবেন? আপনার কথা শুনে ভরসা পাচ্ছি, থাকতে দেবেন?’ কাতর গলায় বলল মেয়েটি, ‘আমার নাম অঞ্জনা, অঞ্জনা বিশ্বাস।’
‘যাচ্চলে! দেখুন, আমি একটা ঘরে একা থাকি। দুপুরে হোটেলে খাই, রাতে যা হোক কিছু বানিয়ে নিই। আপনাকে ঘর ছেড়ে দিয়ে আমি তো রাস্তায় থাকতে পারব না।’ অজয় বলল।
‘আপনি তো ভাল লোক। কোনও অসুবিধে করব না। ভোর হলেই চলে যাব।’
‘কী যে করি! আমার বারোটা বেজে গেল।’
‘কেন?’
‘কাজ থেকে ফিরে রান্না করার সময় আমি দু’পেগ মদ খাই...!’
‘আপনি মাতাল হয়ে যান? ওদের মতো?’
‘না, না। দু’পেগে কেউ মাতাল হয় না। আমি কখনও হইনি।’
‘তা হলে আমার কোনও অসুবিধে নেই।’
একটা ব্লাইন্ড লেনের শেষ বাড়ির এক তলার অ্যাটাচড বাথওয়ালা ঘরে অজয়ের বাসস্থান। বৃষ্টি আবার জোরালো হওয়ায় পাড়ার কোনও মানুষ বাইরে নেই। গাড়িটাকে গলির শেষ প্রান্তে নিজের দরজার সামনে এনে সে বলল, ‘দাঁড়ান, আগে দরজা খুলি।’
দরজা খুলতেই মেয়েটি টুক করে ঢুকে গেল ভেতরে। আলো জ্বেলে দিয়ে গাড়িটাকে লক করতে গিয়ে আপাদমস্তক ভিজে গেল অজয়।
‘ওপাশে বাথরুম আছে। আপনার জামাকাপড় তো ভিজে। এই ভাবে থাকবেন?’
‘অনেক শুকিয়ে এসেছে।’ মেয়েটি, যার নাম অঞ্জনা, বাথরুমে চলে গেল।
দ্রুত ঘরটাকে গুছিয়ে নিতেই অঞ্জনা বেরিয়ে এল। অজয় বুঝতে পারল মেয়েটা সত্যি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে বলল, ‘আমার কাছে মেয়েদের কোনও পোশাক নেই। বিছানার ওপর খবরের কাগজ পেতে দিচ্ছি, শুয়ে পড়ুন।’
‘আমি ওই কোনার মেঝেতে শুয়ে পড়ি?’
‘দেখুন, তিনি বলেছেন আমার বুক থেকে দয়া-মায়া মুছে যায়নি। যা বলছি তাই শুনুন। খাটে উঠে পড়ুন। আমি রান্না করছি, হলে ডাকব। খেয়ে নেবেন।’
‘আমি কিছু খাব না।’
‘আপনার মর্জি।’
বেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অঞ্জনা খাটে শুয়ে পড়ল। শুয়ে দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরল। অভ্যেসে খাট বলে অজয়, আসলে এক জনের শোওয়ার মতো তক্তপোশ। তবে গদি এবং তোষকে বেশ আরামপ্রদ। বাথরুমে ঢুকে পোশাক পাল্টাল সে। চুল মুছল। বেশ শীত-শীত করছে। এ রকম রাতে দু’পেগ পেটে না গেলে...! |
মদ্যপানের অভ্যেসটা করিয়েছিল জিতেনদা, জিতেন মণ্ডল। যার কাছে গাড়ি চালাতে শিখেছিল অজয়। বলেছিল, ‘রাতে শোওয়ার আগে এক কী দুই পেগ গলায় ঢালবি। কখনওই তার বেশি নয়। দেখবি বেশ চাঙ্গা লাগছে। আর খবরদার, কোনও ঠেকে গিয়ে পাঁচ মাতালের সঙ্গে ভিড়বি না। তা হলে সব গোল্লায় যাবে। নিজের ঘরে বসে কোনও কাজ করতে করতে একা খাবি। এই বলে দিলাম।’ প্রথম প্রথম আধ পেগ খেতেই বিশ্রী লাগত। কিন্তু কখনওই সে জিতেনদার উপদেশ অমান্য করেনি। জিতেনদা পঁয়ষট্টি বছরেও এক শিফ্ট চালাচ্ছে। আর যারা ঠেকে যায়, তারা চল্লিশ পার হতে না হতেই ছবি হয়ে যায়।
ডিমের ডালনা আর ভাত। ভাতটাকে আগে বসিয়ে দিয়ে আলু কাটার আগে গ্লাসে এক পেগ ঢালতে গিয়ে মনে হল একটু বেশি পড়ে গেছে। আজকাল বোতলের মুখগুলো এমন ভাবে আটকে দেয় যে, বাড়তি মদ ভেতরে ঢোকানো যায় না। পুরো জল ঢেলে আলু কেটে নিল অজয় মাঝে মাঝে চুমুক দিয়ে। বৃষ্টির শব্দ একটুও কমছে না। এই ঘরে বহু দিনই সে একা থাকছে। আজ যে মেয়েটা এল তাতেও তার মনে হচ্ছে পরিস্থিতি অন্য রাতের মতোই থেকে গেছে।
ভাত হয়ে গেল। ডিমের ডালনা চাপিয়ে দ্বিতীয় পেগ ঢালল অজয়। তার পর মুখ ফিরিয়ে দেখল অঞ্জনা কাটা কলাগাছের মতো পড়ে আছে। অচেনা, অজানা বিছানায় যখন কোনও মেয়ে ওই ভাবে ঘুমায়, তখন বোঝাই যাচ্ছে ওর ভেতরে এই মুহূর্তে কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই।
ডিমের ডালনা নামিয়ে গ্লাসটা শেষ করতেই মনে হল একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেল। তখনই কানে এল, ‘ওয়েল, আর একটা গ্লাস আনো।’
পুরুষকণ্ঠ কানে আসতেই অজয় চমকে বাঁ দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীচে বসে থাকায় মনে হচ্ছে লোকটা বেশ লম্বা, কেতাদুরস্ত কোটপ্যান্ট পরা, মুখে দাড়ি।
সে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ‘কে আপনি? কী ভাবে এই ঘরে ঢুকলেন?’
‘অবান্তর প্রশ্ন। তুমি আর একটা গ্লাস বের করে তাতে মদ ঢালো। হ্যাঁ, একটুও জল মেশাবে না। বাঙালি যে অধঃপতনে গিয়েছে, তা মদ খাওয়ার ধরন দেখলেই বোঝা যায়। তোমরা মদ খাও না জল? ছিঃ ছিঃ।’
‘আপনি কে?’
‘আঃ। বিরক্ত কোরো না। হ্যাঁ, দ্বিতীয় গ্লাসটা আমার জন্যে। কিন্তু সেটা আমার হয়ে তুমি খাবে। আমি দেখব।’
‘কেন?’
‘ইডিয়ট। আমরা এখন ও-সবের ঊর্ধ্বে।’ হতাশ গলায় কথা বলল মানুষটা। ‘বেঁচে থাকতেই তো প্রায় ছেড়ে দিতে হচ্ছিল ওই ব্যাটা পণ্ডিত টাকা বন্ধ করে দেওয়ায়। দেখলাম, তোমাকে খুব জ্ঞান দিয়ে গেল। পুরনো অভ্যেস। কই, ঢালছ না কেন?’ তার পর গুনগুন করল, ‘ঢালো, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তা হলে ঢেলে দাও।’ |
(ক্রমশ)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|