|
|
|
|
|
|
কথোপকথন |
আমার সকল সুরের আরতি |
পুজোয় দিদিমার দেওয়া তানপুরা, হেমন্তদাকে পোড়া কেক খাওয়ানো।
জীবন-পুজোর গল্প পথিক পণ্ডিতকে বললেন আরতি মুখোপাধ্যায়
|
খুব ছোট্টবেলায় বাবা মারা যান। ফলে আমরা অনেকটা দাদু-ঠাকুমার ওপর ডিপেন্ডেন্ট ছিলাম। যা-ই হোক, বাবা বেঁচে থাকতে আয়রন-সাইড রোডের বাড়িতে থাকতাম। যৌথ পরিবার। দাদু-ঠাকুমা-দুই কাকা, এক পিসি, মা আর আমরা সাতটি ভাই বোন। সব্বাই আমাদের খুব ভালবাসতেন। কমপ্যাক্ট ফ্যামিলি ছিল। পরিবারে সবাই সবাইকে ভালবাসত। দাদু-ঠাকুমা, দিদিমা, কাকারা সব মিলিয়ে সুখী পরিবার ছিল। সেই সময় পুজোগুলোতে সবাই নতুন জামাকাপড় পাব, নতুন জুতো পাব এ রকম একটা ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতাম। খুব ছোট্টবেলায় মা-বাবাও পুজোয় কিছু না কিছু দিতেন খুব সুন্দর একটা ফ্রক, রিবন ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা মারা যাওয়ার পর ঠাকুমাই কেনাকাটা করতে নিয়ে যেতেন। মামাবাড়ি থেকে দিদিমাও আসতেন, বলতেন, ‘কী লাগবে?’ মনে আছে সেই বয়সে দিদিমা পুজোর সময় একটা তিনশো টাকা দিয়ে তানপুরা কিনে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে তিনশো টাকার তানপুরা মানে বিরাট ব্যাপার, খুব দামি! সকলের মাঝে থেকে গানবাজনা, পড়াশোনা করেছি। মিউজিক টিচার, কাকা, পিসি, সকলের সঙ্গে বসে গান শেয়ার করতাম। পিসি-কাকারা দারুণ সেতার বাজাতেন। বাড়ির বড়রা জানতে চাইতেন, ‘আজ কী করলে? কেমন করলে? একটু শোনাও দেখি।’ এটাই অভ্যাস ছিল। কী হল, না হল সবাই মিলে বসে আলোচনা করতাম, গল্প করতাম।
পুজো এলে আর একটা জিনিস খুব খেয়াল করতাম। পুজোতে নতুন কী কী গান এল? কার কার গান বেরোল? এই গান শোনার জন্য আমাদের একটা বিরাট পাগলামি ছিল। তার পর একটু যখন বড় হলাম, তখন একটা গানের বই বেরোত এইচ এম ভি থেকে ‘শারদ অর্ঘ্য’। স্কুলের অনুষ্ঠানে শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, আরও শিল্পীরা আসতেন। সবাই খুব আনন্দ করে গান শুনতাম। এমন অনেক শিল্পী ছিলেন, যাঁদের কোনও দিন দেখিনি, দেখব বলেও ভাবিনি। ওই বইটা পেলে ছবিগুলো দেখতে পেতাম। ফলে পুজোর সময় ওটা আমার কাছে ‘এক্সট্রা’ আনন্দ ছিল। আর একটু যখন বড় হলাম, তখন লতা মঙ্গেশকর বাংলাতে গাইতে শুরু করেছেন। ওঁর গান তো ছোট্টবেলা থেকে শুনি, এবং শুনে বড় হয়েছি। ওই বইয়ের সঙ্গে ওঁর ছবিটাও উপরি পাওনা ছিল। সেই কারণে পুজোর জামা-কাপড়ের থেকেও ওই বইটা বেশি আনন্দের ছিল অন্তত আমার কাছে।
দুর্গাপুজোর পরে পরেই লক্ষ্মীপুজো। পাড়ায় পাড়ায় যখন গান বাজত, তখন কার কোন গানটা বাজল? কান খুলে থাকতাম। এটা শুধু আমিই করিনি, সকল ভাই বোনেদের মধ্যেই ছিল। এবং বাড়িতেও বসে এটা নিয়ে আলোচনা করতাম। বাড়িতে গানের চর্চা হত। বাবা মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায় গাইতেন খুব ভাল। সঙ্গে এত সুন্দর অরগ্যান এবং হারমোনিয়াম বাজাতেন, কী আর বলব! উনি কিন্তু কোনও ট্রেনিং নেননি। এটা ইনটিউশন বলতে পারো। মা-ও গাইতেন। মা গান শিখেছিলেন, এবং এসরাজও বাজাতেন। খুব ছোট্টবেলায় মায়ের গানের টিচার আসতেন দেখেছি। বাড়িতে আমার আগে কেউ গানের জগতে প্রফেশনালি যুক্ত ছিলেন না। বাড়িতে গানের চর্চা করা, ভাল গান শোনা এগুলোতে কিন্তু আমাদের এনকারেজ করা হত। বেতারে বড় বড় আর্টিস্টদের ক্লাসিকাল গান হত, ন্যাশনাল প্রোগ্রাম হত। ডেকে ডেকে শোনানো হত। ভাই বোনেরা গান শোনার পোকা ছিলাম। আমিন সায়ানির ‘ভাইয়োঁ ঔর বহেনোঁ’ ‘বিনাকা গীতমালা’ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। ১টা ৪০ মিনিটে ‘অনুরোধের আসর’, রাতে ‘রম্যগীতি’ কিছু বাদ দিতাম না। গান শোনা নিয়ে এটা ছোট্ট গল্প বলি। সারাদিনের ক্লান্তিতে রাত ন’টা-সাড়ে ন’টার সময় হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ রেডিয়োয় ঘোষণা হল আমির খান সাহেবের গান হবে। ব্যস ঘুম থেকে তুলে মা আমির খান সাহেবের গান শোনালেন। জীবনটা গান ওরিয়েন্টেড ছিল। পুজোর সময় মনে আছে, নতুন নতুন জামাকাপড় পরে ঠাকুর দেখতে যাব বলে একেবারে রেডি, হঠাৎ গান নিয়ে বসে গেলাম। |
|
আস্তে আস্তে গানের জগতে আসতে লাগলাম। কম্পিটিশনে যোগ দেওয়া, গুণী শিল্পীদের কাছে গান শেখা। প্রথম দিকে আমার গানের আগ্রহ দেখে মা বাসন্তী বিদ্যাপীঠে ভর্তি করে দিলেন। এখানে স্কুলের সঙ্গে গানের স্কুলও ছিল। এখানে খুব ভাল ভাল শিক্ষক গান শেখাতেন। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, আধুনিক বাংলা সব শেখানো হত। ওখানকার টিচাররা কম্পিটিশনে নাম দিয়ে দিতেন। মা নিয়ে যেতেন কম্পিটিশনে গাওয়ার জন্য। প্রত্যেক জায়গায় প্রথম হয়ে ফিরতাম। সেটা দেখে বাড়ির লোক সকলে উৎসাহিত হলেন। ওঁরা তখন বললেন যে, ‘গানটাই ও ভালবাসে, গানটাই করুক।’
তার পর চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে গান শিখতে শুরু করলাম। ওঁর কাছে অবশ্য বেশি দিন শিখিনি। বছর দেড়-দুই হবে। তার পরে উনি মারা গেলেন। এর পর সাগিরুদ্দিন খান সাহেবের কাছে তালিম নিই। খুব যত্ন করে শেখাতেন, দীর্ঘ দিন শিখিয়েছেন। তালিমটা যা-ই পাই না কেন, বাড়ির উৎসাহটা তার দ্বিগুণ পেয়েছি। কেউ বাধা দিতেন না। গানটা চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার ছিল।
এই স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যাপারে তোমায় একটা গল্প শোনাব। বিয়ে, পৈতের মতো বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে সব আত্মীয়স্বজনরা আসতেন, যথারীতি হইহুল্লোড়ও চলত। হত কী, বাড়ির সব লোক ও আত্মীয়েরা, প্রায় ২৪-২৫ জন মিলে একটা দিন হইচই করে কোথাও থিয়েটার বা সিনেমায় যেতেন। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদেরও ইনক্লুড করতে চাইতেন। কিন্তু ঠিক ওই সময়টাতেই আমার গানের মাস্টারমশাই আসবেন। বলতাম, না, না, আমি সিনেমা বা থিয়েটারে যাব না। বাড়ি থেকে কোত্থাও নড়তাম না, শুধুমাত্র গানের জন্য।
বাচ্চেলাল বলে এক ভদ্রলোক খুব ভাল সারেঙ্গি বাজাতেন। উনি প্রায় সব কম্পিটিশনেই বাজাতেন। উনি এসে আমায় সকালে রেওয়াজ করাতেন। ঠিক ৯টার সময় আসতেন। সেই যে শুরু হল, বেলা একটা পর্যন্ত চলত রেওয়াজ। এই রাগ, ওই রাগ, এটা ওই রকম, ওটা ও রকম, এ তালটা এই ভাবে গেছে, সারাক্ষণ এর মধ্যেই থাকতাম। কখন যে সময় কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। এখন মনে হয়, ওই রেওয়াজ যদি এখনও করতে পারি তাতে তো কোনও ক্ষতি হবে না, মনও ভাল থাকবে।
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপটাও অদ্ভুত ভাবে ঘটেছিল। একটি কম্পিটিশনে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য জাজ ছিলেন। নিয়ে গিয়েছিলেন মাস্টারমশাই সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়। উনিও ওই কম্পিটিশনে সেকেন্ড জাজ হিসেবে ছিলেন। আমার গান শুনে ধনঞ্জয়বাবুর খুব ভাল লেগেছিল। তখন উনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বললেন, ‘তুমি গাইবে, একটা ছবিতে?’ ওঁর সঙ্গেই বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের একটি গান ছিল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মামলার ফল’ ছবিতে। বিখ্যাত সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায় ওই ছবির সুরকার ছিলেন। বললাম, আমি তো বলতে পারব না। মাস্টারমশাইকে বললাম, মাকে বলুন। মাকে বলাতে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই গাইবে।’ তার পর আমাকে দিয়ে ওই ছবিতে গাওয়ানো হয়েছিল। সেটাই আমার প্রথম প্লেব্যাক করা।
একই ভাবে হেমন্তদার সঙ্গে পরে যোগাযোগ হয়েছিল। তবে আমি তখন একটু একটু করে নাম করে ফেলেছি। তখন ‘দেয়ানেয়া’, ‘শঙ্খবেলা’, ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে গান গেয়ে ফেলেছি। এই ভাবেই আস্তে আস্তে এগিয়ে গেছি।
আমার স্বামী শ্রেয়স মনিম বিখ্যাত সলিসিটর হলেও, সঙ্গে ফোটোগ্রাফিটাও দুর্দান্ত করে। অবসর পেলেই আমরা লং ড্রাইভে চলে যেতাম খান্ডালা বা পুণে। ওখানে নির্জনে বসে একটার একটা গান শুনে যেতাম। সঙ্গে ভূরিভোজ তো ছিলই। আর শ্রেয়স আমার বিভিন্ন স্টাইলের ছবি তুলত। মাঝেমধ্যে আমার গান বাড়িতে বসে রেকর্ডও করত। এতেই নাকি ওর আনন্দ। মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে এক বার হেমন্তদাকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। বলি? এক দিন ডিনারের জন্য হেমন্তদাকে নিমন্ত্রণ করলাম। হেমন্তদা এসে আবদার করে বললেন: ‘আলো, (আমার ডাকনাম) আজ তোমার হাতে তৈরি কেক খাব।’ কেক-এর সব কিছু উপকরণ ঠিকঠাক করে আভেনে চাপিয়ে দিলাম। ও দিকে কেক তৈরি হতে থাকল, আর এ দিকে আমরা আমির খান সাহেবের গান শুনতে বসে গেলাম। এ কী, হঠাৎ কোথা থেকে যেন পোড়া পোড়া গন্ধ বেরোতে লাগল! মনে পড়ল, আরে আমি হেমন্তদার জন্য আভেনে কেক বসিয়ে এসেছি! রাতের খাবারের সঙ্গে পোড়া কেকও হেমন্তদার পাতে দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন ‘আলো, গানের সুরের মতোই এ কেক কিন্তু এক আলাদা স্বাদ নিয়েছে!’
ছোটবেলায় যখন একটু বড় হয়েছি, পুজোর কাপড়জামাতে একটু আগ্রহও বেড়েছে। তা বলে গান বাদ দিয়ে কখনও কিছু করিনি। পুজোয় গানটা যখন এল, নিজেকে তখন অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগী হিসেবে ভাবতে লাগলাম আমাকেও তো গাইতে হবে, আমাকেও তো এই জায়গাটায় আসতে হবে। তার আগে অবশ্য এইচ এম ভি-তে আমার দুটো অ্যালবাম বেরিয়ে গিয়েছিল। সুধীন দাশগুপ্তর সুরে সে গান সুপার হিট হয়ে গেছিল টাপুর টুপুর সারা দুপুর...।
এ ভাবেই গানটাকে আঁকড়ে ধরে কত ভাল করে গাওয়া যায়, নতুন নতুন গান, নতুন নতুন বিভিন্ন মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করেছি। একটা বছরে এক এক জনের গান করেছি। আজ তো প্রত্যেকটা গানই এক একটা মাইলফলক বলা যেতে পারে। গানগুলোর পিছনে প্রচুর পরিশ্রম ছিল। শুধু আমার নয়, যাঁরা সুরকার ছিলেন, যাঁরা গীতিকার ছিলেন এবং যাঁরা যোগাযোগ করিয়ে দিতেন, প্রত্যেকের সমান পরিশ্রম ছিল। তখন একটা রেকর্ডে দুটো গান থাকত। তার জন্য সারা বছর প্রচুর খাটতে হত। হয়তো একটা গান লেখা হল, সুরকারের পছন্দ হল না, তো ছিঁড়ে ফেলে দাও। এই ভাবে নানান এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে একটা গান তৈরি হত। কী ভাবে গানটাকে ভাল লাগানো যায় লোকের কাছে বা কী ভাবে প্রেজেন্ট করলে মানুষের ভাল লাগবে, এর একটা আপ্রাণ চেষ্টা ছিল। যাতে লোকের প্রথম শুনেই ভাল লাগে, তার জন্য যে আপ্রাণ প্রয়াস ছিল, আজ ভাবলে মনে হয় ওই রকম প্রচেষ্টা না থাকলে ওই গানগুলো আজ কোথায় হারিয়ে যেত।
আমাদের বিশাল বাড়ি ছিল ঢাকায়। তারই অনুকরণে দাদু সাড়ে চার বিঘে জমির ওপর আমাদের নাগেরবাজারের বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। আসলে দাদুর ইচ্ছে ছিল, বাড়ির মধ্যে বাগান থাকবে, পুকুর থাকবে, ওখানেই আমরা সাঁতার কাটব, ওখানে খেলাধুলো করব। এখন লোকে ওই রকম বাড়িকে বাংলো বাড়ি বলে। বাড়ির ভিতর নার্সারি ছিল, মানে ফুলের বাগান, ফলের বাগান, মালি ছিল। ওখানে সাতখানা গরুও ছিল। কাজের লোকটোক তো ছিলই। ওই বাড়িতে বড় হয়েছি তো, তাই মনটাও আমাদের ছড়ানো ছিল। এখন এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতে কষ্ট হয়।
ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। আমি সাগিরুদ্দিন খান সাহেবের বাড়িতে গান শিখতে যাই। সেই সময় ঋত্বিকদা ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমার জন্য নতুন মুখ, নতুন গলা খুঁজছেন। মাস্টারমশাইকে বললেন, ‘‘সুবর্ণরেখা’ ছবির গানগুলোর জন্য নতুন গলা, নতুন মেয়ে হলে ভাল হয়। আপনার কেউ চেনাজানা আছে?’ স্যর বললেন, ‘আমার এক ছাত্রী আছে, এখুনি আসবে রেওয়াজ করতে। ওর গান শুনে দেখতে পারেন।’ গান শুনে ঋত্বিকদার ভাল লাগল, তার পর নায়িকা মাধবীর লিপে ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে গাইলাম।
তপন সিংহ, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, অসিত সেন, তরুণ মজুমদার, সকলের ছবিতে আমি গান গেয়েছি। আমার মনে আছে, ‘সাগিনা মাহাতো’র গান হচ্ছে, তপনদা বললেন, ‘আরতি, তুমি তো গাইলে গানটা, তোমার কেমন লাগল?’ ‘ছোট্টি সি পাঞ্ছি’ তো তপনদারই সুর। রেকর্ডিং হয়ে গেছে, তখন জিজ্ঞেস করছেন, ‘গানটা চলবে তো?’ বললাম, হ্যাঁ, গানটা তো ভারী মিষ্টি। ‘তুমি বলো, গানটা লোকের ভাল লাগবে তো?’ হ্যাঁ দাদা, গানটা লোকের খুব ভাল লাগবে। ওঁর মতো লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মানে, বুঝতে পারতাম কত ভাবেই না গানটা উনি টেস্ট করেছেন। ওই সাধনা, ইচ্ছা ও প্রয়াসটা একটা ভাল গান তৈরিতে সাঙ্ঘাতিক ভাবে কাজ করে।
পিন্টু ভট্টাচার্য যখন নতুন এল, তখন নচিদার সুরে একটা গান গাইল ‘রাত দুপুরে দুষ্টু বাঁশি বাজে...’, সুপার হিট। কী রোমান্টিক গান, তখন কিন্তু গায়কের গলা শুনে ওঁরা চিন্তা করতেন, কী ধরনের গান দিলে ওই গায়কের গলায় ভাল শোনাবে এবং লোকের ভাল লাগবে। সুধীনদা তো আমাকে দিয়ে প্রচুর ফিল্মে গাইয়েছেন। ওঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি। অনেককেই নিয়ে যেতাম। যার মধ্যে এক জনের নাম বলব, অনুপ ঘোষাল। যেই বছর আমি গাইলাম ‘বন্য বন্য এ অরণ্য...’ সেই বছরই অনুপের গানটা হয়েছিল। অনুপকে নিয়ে গেলাম সুধীনদার কাছে। সুধীনদা ওর গান শুনে কিছু বললেন না, কিন্তু ভাল লাগল বুঝেছিলাম। ওর গান শুনে উনি বুঝে গিয়েছিলেন ওকে দিয়ে একটু রাগদারির গান, সঙ্গে ক্লাসিকাল, একটু গিমিক থাকবে এই রকম গান গাওয়াবেন, অর্থাৎ এই ধরনের গান ওর গলায় মানাত। ‘আর তো চিন্তা নাই রে...’, ‘বিয়ে করবই না...’ করিয়েছিলেন। দারুণ নাম করল ও।
আজ দেখতে দেখতে এত বড় হয়েছি, যেখানে যাচ্ছি সেখানেই সেই পুরনো গান বাজছে, বা কোথাও অনুষ্ঠান করতে গেলে রিকোয়েস্ট আসছে পুরনো গানগুলো গাওয়ার। গানের কলি ভুলে গেলে শ্রোতারা বলে দিচ্ছেন ‘না দিদি, এটা নয়, এ রকম হবে।’ তার মানে বুঝতেই পারছ ভালবাসার জায়গাটা ঠিক কোথায়?
ঋত্বিকদার ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে গান করতে গিয়েই যোগাযোগ হয়েছিল ‘গীত গাতা চল’ ছবিতে গাওয়ার জন্য। হিন্দি ছবিতে সেটাই আমার প্রথম ব্রেক। তার পর একের পর এক হেমন্তদা, রফিজি, অনেকের সঙ্গে ডুয়েট গেয়ে গেছি, পিছন ফিরে আর তাকানোর সময় পাইনি।
এখন লোকেরা বলেন না, টাইম পাস করা বা বোরড হওয়া। আমি এখনও বলতে পারি, বোরডম আমার জীবনে কোনও দিন আসেনি, শব্দটা আমার কাছে অর্থহীন। জীবনে কোনও দিন বোরড হইনি। টাইম পাসেরও কিছু নেই। কারণ, সঙ্গীত এত বড় একটা সাবজেক্ট ক্লাসিকাল শুনছি ভাল লাগছে না, চলো একটু গজল শুনি, তার পর একটু ফোক শুনলাম, আধুনিক শুনলাম, ওয়েস্টার্ন শুনলাম, ইনস্ট্রুমেন্টাল শুনলাম।
দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতও আমি আলাদা করে শিখেছি। উনি যত্ন করে শেখাতেন। কোন রাগের উপরে কোন গান, এই জায়গাটা এই ভাবে করো। এখনও গান শুনতে ভালবাসি। কেউ এক জন ভাল গাইলে আমার কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মন থেকে বেরিয়ে আসে আঃ কী ভাল গাইল! মনটা ভাল হয়ে যায়।
‘মাসুম’ ছবির গান আমায় ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড এনে দেয়। বি এফ জে-র মতো প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ড তো পেয়েইছি। এ দিক ও দিক থেকে প্রচুর স্মারক পেয়েছি। যেগুলো ভালবেসে, ভালবাসার ফলস্বরূপ দিয়েছে। তবে গানের লাইন ভুলে গেলাম, আর শ্রোতারা মনে করিয়ে দিল এই পাওয়াটা আরও বড় পাওয়া।
পুজোর ছুটির দিন ক’টা খুব ভাল লাগে। সকলের সঙ্গে দেখা, থাকা, কিন্তু সেই গানের উন্মাদনা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। নতুন গানের জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি, পুজোয় কী শুনব? কী বেরোবে? এখন পুজোর গান বেরোয়, কিন্তু যখন যেখানে যাই শুনি সেই পুরনো গানগুলোই। কেন?
পুজো নিয়ে আমি কখনও মাতামাতি করতাম না। আগে তাও যেতাম, এখন তো কিছুই করি না, বাড়িতেই আমি ঠাকুরের পুজোআচ্চা করি, আমার ওই ভিড়, ধাক্কাধাক্কি পছন্দ হয় না। একটা চেতনা হয় যে, ভগবানকে ডাকি, ভগবানকে ভালবাসি, ঈশ্বর তো আছেন। সেটা আমি গভীর ভাবে চিন্তা করি। একটু বই পড়লাম, একটু জপ করলাম, কিন্তু ওই উন্মাদনা নেই, অমুক প্যান্ডেলে যেতে হবে, অঞ্জলি দিতে হবে, এ সব আমার কিছু নেই। কোনও দিনই ভাল লাগেনি। আমি গান নিয়েই থাকি, পুজোর সময় নতুন কাপড় পরতেই হবে, এমন কোনও ব্যাপার নেই। একটা বয়েসে পরেছি, ভাল লেগেছে। আমার একটা বিখ্যাত গানের কলি আছে না, ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়/আমি তখন অষ্টাদশী ছোঁয়ায়’, হ্যাঁ, ওই বয়সেই চলে গেছে আমার পুজোর উন্মাদনা। আর আসেনি। এখন পুজোর সময় শারদীয়া সংখ্যাগুলি পড়ি, ওই পড়েই আমার আনন্দ। এবং ফিতেটিতে কাটতে জ্ঞানত আজ পর্যন্ত কোথাও যাইনি। এগুলোকে অ্যাভয়েড করে চলি।
আগে তো ফিতে কাটাটাটা, এ সব কিছুই ছিল না। আমরা দেখতাম, যথারীতি পঞ্চমীর দিন ঠাকুরমশাই আসবেন, মাকে আবাহন করবেন, বড়রা ছোটরা প্যান্ডেলে যাবে, এটাই তো হয়ে আসছে চিরকাল। ফিতে কাটার কোনও ব্যাপার ছিল না। বিদেশ থেকে যাঁরা আসেন মূর্তি উন্মোচন করতে, বা ফিতে কাটতে, তাঁরা কি জানেন দুর্গাপুজোটা কী জিনিস? আর্ন সাম মানি ছাড়া কিছুই জানেন না।
আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাবা চলে গেছেন তো। ফলে আমাদের খুব কষ্ট হত পুজোর সময়টা। নতুন কোথাও জুতোর বিজ্ঞাপন দেখলাম, ঠাকুমা বা দিদিমা আমাদের নিয়ে যেতেন দোকানে। আমরা পেয়েছি সকলের ভালবাসা। কোনও কিছু মিস করিনি। কষ্ট হত খালি বাবার জন্য। বিশেষ করে, এই পুজোর সময় আমাদের মতো ছোটরা যখন তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোত, তখন মনটা খারাপ হয়ে যেত। বাবাকে তো সব কিছু বলতাম। তার পরে ভাবলাম কত লোক কত কষ্ট করে আছে, আমরা তো তাদের থেকে অনেক ভাল আছি।
|
গ্রাফিক: অরিন্দম মজুমদার |
|
|
|
|
|