আবহাওয়া ছিল উৎসবের। কিন্তু প্রশাসনের গা ছাড়া মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তা পরিণত হল চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায়। অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে লুঠপাট, তোলাবাজি, চুরি-ছিনতাইয়ের অবাধ ক্ষেত্র হয়ে উঠল শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনার টাকিতে বিসর্জন উপলক্ষে দুই বাংলার মিলনোৎসব।
বিএসএফ, পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনেই ট্রলার বজরা, লঞ্চ, ভুটভুটি ও ছোট নৌকা বোঝাই করে এ দিন ওপার থেকে আসা প্রচুর মানুষ ঢুকে পড়লেন এ পারে। এ পারে প্রচুর মানুষের ভিড়ের সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তাতেই চলল মদের আসর। চলল লুঠপাট, চুরি-ছিনতাই। শ্লীলতাহানির শিকার হলেন অনেকে। এক সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে লাঠিও চালাতে হয়। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাঁরা শান্তিতে দুই বাংলা মিলনের উৎসব প্রত্যক্ষ করতে এসেছিলেন এমন পরিস্থিতিতে পড়ে প্রাম বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। এমনকী অনেকের বিসর্জন দেখার ইচ্ছা থাকলেও ভয়ে ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের এবং বিএসএফের এ হেন গাফিলতিতে ক্ষুব্ধ টাকির মানুষ দুই বাংলার মিলনের নামে এমন বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার দাবিও তুলেছেন। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁরা জানাবেন বলে জানিয়েছেন। |
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টা। টাকির ইছামতী নদীর বিভিন্ন ঘাটে তখন জমিদার বাড়ির প্রতিমা, বারোয়ারি প্রতিমা আনা হচ্ছে বিসর্জনের জন্য। ওপার থেকে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, “একটু পরেই দুই বাংলা মিলবে। এই মুহূর্তটা আমাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের, গর্বের। আনন্দে সামিল হোন আপনারা। ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল, ট্রলার, বজরা, লঞ্চ, ভুটভুটি ও ছোট নৌকা এদিকে আসতে শুরু করেছে। সবকটিতেই বোঝাই মানুষ। এ পারে ভিড়তেই হুড়মুড়িতে নেমে পড়লেন তাঁরা। পরের পর মানুষ বোঝাই নৌকা। যেন বিরাম নেই। নদীতে যথারীতি টহল দিচ্ছে বাংলাদেশ রাইফেলস এবং বিএসএফের স্পিটবোট। দুই পারেই রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশ। কিন্তু নজর রাখা ছাড়া আর কিছুই করছেন না তাঁরা। যে দিকে তাকানো যায় শুধুই মানুষ। প্রতিমা তেমন চোখে পড়ল না।
এই দৃশ্য টাকিতে নতুন নয়। প্রতি বছর পুজোয় বিসর্জনে এটাই দেখা যায়। তবে, এ বার যেন ছিল লাগামছাড়া। কেন এতটা উন্মুক্ত সীমান্ত?
প্রতিমা নিরঞ্জনের আনন্দে সামিল হয়েছিলেন ওপারের সাতক্ষীরা জেলার দেভাটা, শাকদা, ভাতশালা গ্রামের করিম মোল্লা, লায়লা বিবি, খগেন মণ্ডল, মালবিকা মিস্ত্রীরা। তাঁদের কথায়, প্রতিবারই এমনটা হয়। তবে এ বার মানুষ বেশি এসেছেন বিজয়ার আনন্দে সামিল হতে। তবে এই সামিল হওয়ার ধাক্কায় এ পারে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে প্রশাসনিক পরিকাঠামো। ভিড়ের মধ্যে অবাধে চলতে থাকে চুরি-ছিনতাই, লুঠপাঠ। বিভিন্ন জায়গায় বসে যায় মদের আসর। শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটে। আতঙ্কে অনেকে বাড়ি ফিরে যান। যাঁরা পরে বেরোবেন ভেবেছিলেন, তাঁরাও সব শুনে আর বাড়ি থেকে না বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেন। |
টাকি নাগরিক কমিটির সম্পাদক এবং কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অজয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “দোকানে ঢুকে লুঠপাট, মারামারি করা হল। যত্রতত্র নোংরা আবর্জনায় ভরে গেল। এই অত্যাচার সহ্য করা যায় না। পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। আর এরই সুযোগ নিয়ে মৈত্রীর নামে এ দেশে ঢুকে পড়ল হাজার হাজার মানুষ। এটা কখনও মেনে নেওয়া যায় না। এমনটা যাতে আর না ঘটে সে জন্য আমরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছি।” টাকির পুরপ্রধান সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা চাই না প্রতিমা নিরঞ্জনের নামে এমন অনুপ্রবেশ ঘটুক। পুলিশ-বিএসএফের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে দুষ্কৃতীদের অত্যাচার সীমা ছাড়ায়। বিষয়টি আমরা দিল্লিতে জানাব।”
এ ব্যাপারে বিএসএফের জনসংযোগ দফতরের (দক্ষিণবঙ্গ) এক আধিকারিক জানান, এ দিন নদীতে বিএসএফের যথারীতি টহলদারি ছিল। বিসর্জন দেখতে বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ ইছামতীতে নৌকা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন। এ পারে কেউ আসেননি। তবে অনুপ্রবেশের অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন বিষয়টি অবশ্য তদন্ত করে দেখা হবে। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করে বসিরহাটের এসডিপিও আনন্দ সরকার বলেন, “আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। তবে অন্যবারের চেয়ে এ বার বেশ ভিড় হয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে সে দিকে লক্ষ্য রাখা হবে।”
|