প্রতি পক্ষ
অন্ধ প্রদীপ শূন্য পানে...
দাঁড়িয়ে আছি, আসা-যাওয়ার পথের ধারে।
এই তো কয়েক দিন আগে, এত আলো! রাস্তায় রাস্তায় জনস্রোত! বিলবোর্ডে উপচে পড়ছে সুখ। আজ, মাত্র দিন কয়েকের ব্যবধানে, সবটাই যেন অলীক। শূন্য পানে চেয়ে আছে একটি প্রদীপ। ছোট্ট এক টুকরো আগুন। মণ্ডপের সাজ কমবেশি থেকে গিয়েছে এখনও। চরাচরের সর্বাঙ্গে ক্লান্তি।
শুধুই ক্লান্তি? না কি, বিষণ্ণতাও? উৎসব শেষ হওয়ার বিষণ্ণতা? সে তো আছেই, নিশ্চিত। পাশাপাশি, কোথাও কি থেকে গেল না কিছু কাঁটা? উৎসব শুরুর আগে যা ছিল, ফুরনোর পরেও তো তা-ই। বদলাল কি কিছু? বদলায় কি কিছু? ঠিক জানা নেই, কিন্তু আশা থাকে। মেলাবেন, তিনি মেলাবেন। প্রতি বারই জেগে ওঠে আশা। আশ্বিনের শারদপ্রাতে, নীলচে আঁধার আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, আধোঘুমে আচমকা খুব অলৌকিক লাগে এই জীবন। মনে হয়, পাল্টাবে। ‘জাগো অসুর-বিনাশিনী’ তখন আর শুধু গান-ই থাকে না, কোথাও তা একটা বিশ্বাসের আলোও পায়। অসুর বিনষ্ট হবে। অন্ধকার দূর হবে। জেগে উঠবে আলো।
সেই প্রতীক্ষাতেই তো প্রতি বার মহালয়ার ভোররাতে রেডিও, প্রতি বার অন্ধকার-মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজে বেড়ানো, কোথায় আলো?
কথা ছিল, আলো আসবে। না হলে আর ‘আলোর বেণু’ শুনে এই ঘোর কনজিউমার জীবনেও এক পলক আনমনা হই কেন? কেন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ভাবি, নিশ্চয়ই আলোর কোনও প্রতিশ্রুতি আছে কোথাও...
কথা ছিল, অসুরেরা নিহত হবে। মহিষমর্দ্দিনী যদি প্রতীকী অর্থে বিনাশ করেন অশুভকে, তা হলে তার রেশ লাগবে এই প্রত্যহের জীবনেও। অসুর তো কম নেই, প্রতিনিয়ত ত্রস্ত আছি তার শাপে, রাস্তায় যেতে যেতে, কিংবা ব্যস্ত বাজারের কোনও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যদি চোখে পড়ে খুব নিরীহ কোনও থলি, পড়ে আছে চুপচাপ, দাবিদারহীন, সহসা কেঁপে উঠি। আড়চোখে এ দিক ও দিক...কেউ কি তাকিয়ে আছে সন্তর্পণে? সে রকম কারওকে চোখে পড়ে না, কিন্তু তাতেই তো আরও বেড়ে যায় চিন্তা! কে জানে, যদি ওর ভিতরে...ভাবনা বেশি দূর এগোয় না। চিন্তা অসাড় হয়। খুচরো ফেরত দিতে গিয়ে দোকানি একটু অবাক হয়ে বলে, কিছু ভাবছিলেন?
কী করে বলব, কী ভাবছিলাম?
রাত্রিবেলা, আদিগন্ত জমাট অন্ধকার চিরে ছুটে-চলা ট্রেনে আচমকা ঘুম ভাঙে মধ্যরাতে। দুলছে ট্রেন। গতির বশেই দুলছে। জানা কথা, কিন্তু আচমকা খটকা লাগে। কে জানে, যদি এই জনমানবহীন অঞ্চলে লাইনের নীচে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকে একটি বোমা! এই ট্রেনেরই অপেক্ষায়? যদি নিঃসাড়ে কেউ বা কারা খুলে নিয়ে গিয়ে থাকে লাইনের প্যান্ডোল ক্লিপ? এই যে এ দিক ও দিক সারি সারি ঘুমন্ত মুখ সব যদি এক লহমায়...
বাতানুকূল কামরার মধ্যেও জমে ওঠে বিনবিনে ঘাম! ট্রেনের তীব্র শিসে লাইনের ধার থেকে ঝটপট করে উড়ে যায় রাতচরা পাখি। ভেঙে-যাওয়া ঘুম আর আসে না। মনে হয়, কাচের জানলার বাইরে ও কার মুখ?
অসুর!
রাত্রিবেলা বাড়ি ফেরার পথে ভাইবোনের উদ্দেশে পিছন থেকে অশ্লীল ইঙ্গিত ছুড়ে দেয় কে? হাতে দেশি মদের বোতল, মুখে গালিগালাজ। প্রতিবাদ করতে গেলেই বেধড়ক মার। কুৎসিত হাত এগিয়ে আসে বোনের শরীর তাক করে। ওই হাত কার?
অসুর!
শহরের রাস্তায় আচমকা টলে পড়ে যান কোনও বৃদ্ধ! বা, দুর্ঘটনার শিকার কোনও যুবা পড়ে থাকেন সংজ্ঞাহীন। পাশ দিয়ে চলে যায় অজস্র মানুষ, নির্বিকার। যেন দেখতেই পান না সেই দৃশ্য! যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাবে পাশ কাটিয়ে যে যার নিজের কাজে...কলকাতা ক্রমেই কল্লোলিনী হয়ে ওঠে নিজের নিয়মে আর গভীরে কোথাও জমে ওঠে আঁধার। অদ্ভুত আঁধার।
কথা ছিল, সেই আঁধার কাটবে তোমারই আলোর ইঙ্গিতে।
কাটল কি?
কথা ছিল, অসুরেরা নিহত হবে তোমারই অস্ত্রে?
হল তো?
বিজয়ার পরে ঠিক একটি দিন পেরিয়ে, দাঁড়িয়ে আছি এই সব প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্ন আর সংশয়।
আসা-যাওয়ার পথের ধারে ছোট্ট প্রদীপ জেগে আছে এখনও।
তার একরত্তি শিখাটুকু একটি প্রশ্নচিহ্নের মতো তাকিয়ে আছে।
শূন্য পানে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.