|
|
|
|
|
|
একটু লক্ষ্মী হও... |
একটু আগেকার কলকাতার মতো করলে হয় না? যেখানে অন্তত
লক্ষ্মী এলে একটু শান্তিতে বসতে পারেন? লিখছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
লক্ষ্মী মেয়ে, লক্ষ্মী বউ, এ সব তো অনেক শুনেছি। ছোটবেলায় খুব শান্তশিষ্ট ছিলাম, মানে আসলে নেহাতই বোকা ছিলাম, তাই মাঝে মাঝেই ‘লক্ষ্মী ছেলে’ সার্টিফিকেট পেতাম, তখন বেশ লাগত, এখন মনে পড়লে গা জ্বলে যায়, কারণ টের পাই, ওই লক্ষ্মী ছেলে এক-শৈশব দুষ্টুমিকে বেমালুম লোপাট করে দিয়েছে। যাক সে কথা, যে দিন গিয়াছে চলি, সে আর ফিরিবে না। কিন্তু কিছু দিন আগে এক বন্ধুর মুখে একটা কথা শুনে বেশ লেগেছিল। তিনি অনেক দিন ইংল্যান্ডে ছিলেন। সে দেশে বেড়ানোর গল্প করছিলেন। কথাচ্ছলে বললেন, ‘ওদের দেখে ভারী হিংসে হয়, সব কিছু কেমন সুন্দর করে, লক্ষ্মী করে সাজিয়ে রেখেছে!’
এমনিতে তেমন কিছু নয় কথাটা, জানি। লক্ষ্মী মানে শ্রী, লক্ষ্মী মানে সুরুচি, এ সব তো খুব চেনা কথা। লক্ষ্মীর সঙ্গে কুবেরের তফাত বিষয়ে জমিয়ে লিখে দিতে পারি, দশে সাড়ে সাত পেয়ে যাব ঠিক। কিন্তু একটা দেশকে লক্ষ্মী করে রাখা? শুনেই মনটা কেমন ভাল হয়ে যায় না? আর হ্যাঁ, সত্যিই একটু হিংসে হয়। আমাদের নতুন মুখ্যমন্ত্রী যখন কলকাতাকে লন্ডন বানানোর কথা বলেন, তখন সেই হিংসেটা বিশেষ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটু রাগও হয়। বেশ তো আছি এই আদিগন্ত কল্লোলিনীকে নিয়ে, যত্রতত্র আবর্জনা, রাজপথ জোড়া খানাখন্দ, যে কোনও সিঁড়ির কোণে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া পানের পিক, লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ, মেঘ মানেই নোংরা জল, দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে। কেউ এ শহরকে মন্দ বললে তেড়েফুঁড়ে উঠি মুহূর্তে, বলি, ‘হতে পারি দীন’ ইত্যাদি। বলি, ‘ও সব বাইরের সাজসজ্জা রাখো, এমন প্রাণ কোথাও দেখেছ?’ বলি, ‘বাইরের মালিন্যটাই দেখলে, এ মহানগরের অন্দর যে কত অ-মলিন, সেটা চিনলে না?’ এ সব বলি আর দিনের পর দিন একই সঙ্গে ফুটপাথে কলার খোসা এবং দৈনন্দিন কুচুটেপনা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলি, দুটোই সমান বিপজ্জনক। এখানে কেউ লন্ডনের স্বপ্ন দেখায়? অলক্ষ্মী নিয়ে বেশ ঘর করছি, খামখা কেন মনে আনো লক্ষ্মীর প্রতিমা?
আসলে আমরা, মানে এই তথাকথিত মহানগরের নাগরিকরা কখনওই আমাদের শহরটাকে সুন্দর করে, সুশ্রী করে, লক্ষ্মী করে সাজার কথা ভাবিনি। ভাবি না। ওটা আমাদের ধাতে নেই। আমরা নিজেকে সাজিয়ে তুলি, সে জন্য আমাদের চিন্তা আর পরিশ্রম আর ধৈর্যের কোনও সীমা পরিসীমা নেই। এ ব্যাপারে আগে নারী-পুরুষ ভেদ ছিল, এখন আর নেই, এখন যে কোনও সেলুনে যান, ঝাড়া এক ঘণ্টার কমে কোনও পুরুষের সজ্জা শেষ হয় না, ‘শুধু চুল কাটব’ বললে সেলুন-কর্মীর মুখ দেখে মনে হয় শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা। আমরা নিজের নিজের ঘরটিও দিব্যি সাজিয়ে তুলি, অন্দরসজ্জা এখন আর নিছক আর্ট নয়, রীতিমতো উচ্ছ্বসিত কমার্স। কিন্তু সেই সজ্জাসচেতন, রুচি-অন্ত-প্রাণ মহানাগরিক আমিই যে মুহূর্তে ঘরের বাইরে পা রাখলাম, অমনি কারও প্রতি আর কোনও দায় নেই, যেখানে যা খুশি ফেলতে পারি, প্যাকেট-খোলা প্লাস্টিক, আইসক্রিম-ফুরনো কাগজের কাপ, শেষ-হওয়া সিগারেট, পান-মশলার রস, নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর বীজ, সব। বেমালুম। নির্বিচারে। ভ্রুক্ষেপ না করে। |
|
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী |
এবং এই শহর আমাদের প্রতিনিয়ত ভ্রুক্ষেপ না করার প্রেরণা দেয়, দিয়ে চলে। যে দিকে তাকাই, একটা শহর অহোরাত্র একমনে অসুন্দরের উপাসনায় রত। ক্ষতবিক্ষত রাস্তাঘাট, অধিকৃত ফুটপাথ, কুচিত্রিত দেওয়াল, হোর্ডিং-আবৃত আকাশরেখা, এ সবের বৃত্তান্ত ছেড়েই দিলাম, চর্বিতচর্বণে লাভ কী? কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে ভাল, ঝকঝকে, এ রকম নানা ইমারত কিংবা বিপণির অন্দরে যান, সেখানেও আপনি বড় জোর কুবেরকে পাবেন, লক্ষ্মী অ-দৃশ্যা। সরকারি অফিসের, এবং বহু বেসরকারি অফিসেরও, রিসেপশন থেকে অন্দরমহল পর্যন্ত সর্বত্র অযত্ন আর অশ্রদ্ধার প্রদর্শনী আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আধুনিক, সুসজ্জিত বহু-বিপণির সাজানো চত্বর ছেড়ে রাস্তায় পা ফেলুন, গোটা ফুটপাথ জুড়ে থিকথিক করছে রকমারি জলদি-খাবারের ঠেলাঠেলি ভিড়, সেখানেই গোগ্রাসে খাওয়া, সেখানেই ভুক্তাবশেষ বিসর্জন, এবং সেই ফুটপাথ থেকে রাস্তায় পা রাখবেন, তার জো নেই, কোটি কোটি অটোরিকশ চলাচলের বিভিন্ন অবস্থায় বিরাজমান, দিঘার সমুদ্রসৈকত ছাড়া এমন ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার দৃশ্য পৃথিবীতে কোথাও খুঁজে পাবেন না।
কিন্তু এই শহরে অলক্ষ্মীর বিজ্ঞাপন সবচেয়ে বেশি উৎকট লাগে ঠিক সেই চত্বরটিতে, যা নিয়ে সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির উন্নাসিক গর্বের অন্ত নেই। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এর সামনের এলাকাটির কথা বলছি। এক কালে, মনে আছে, গিয়ে দাঁড়ালেই মন ভাল হয়ে যেত। কিছুটা নিশ্চয়ই মনের গুণ, কিন্তু সবটা নয় আর কিছু না থাক, ওখানে একটা শান্তি ছিল, প্রতীক্ষায় না হোক, আপন মনেই দু’দণ্ড দাঁড়ানোর অবকাশ ছিল। এখন? সম্পূর্ণ পরিসরটি একটি রেস্তোরাঁয় পরিণত, এবং কয়েক বছর আগে তারই অপর প্রান্তে সংযোজিত হয়েছে রাস্তার ওপর একটি আস্ত শৌচালয়! প্রথম যে দিন দেখি, বিশ্বাস করতে পারিনি। এটা হতে পারে? এমনকী এই শহরেও? আপনি একটা ‘ঐতিহ্যমণ্ডিত’ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোলেন, নানাবিধ ভাস্কর্যে শোভিত উপবনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নাটকের গুণাগুণ সম্বন্ধে বুদ্ধিমান আলোচনা ও বিতর্ক করতে করতে রাস্তায় এসে পড়লেন, আপনার বাঁ দিকে এগ-চিকেন রোল, উল্টো দিকে মোহর কুঞ্জ, এবং ডান দিকে পাবলিক টয়লেট। অথচ, শুনেছি, এই নিয়ে প্রশ্ন করলে শহরের অভিভাবকরা বলেছেন, ‘কেন? ওখানে তো অনেক মানুষ যান, দরকার তো!’ ভাবি, প্রত্যেকটি প্রেক্ষাগৃহের সামনে কেন একটি করে প্রশস্ত শৌচালয় থাকে না। মানুষ তো নিশ্চয়ই যাবেন, দরকার তো!
এই শহরকে লন্ডন করব আমরা? তার আগে একটু আগেকার কলকাতার মতো করলে হয় না? যেখানে অন্তত লক্ষ্মী এলে একটু শান্তিতে বসতে পারেন? নতুন মুখ্যমন্ত্রী মা-মাটি-মানুষ কথাটি খুব পছন্দ করেন। মা তো অনেক রকমের হয়। মায়ের দুটি রূপ আমরা খুব সাড়ম্বরে পুজো করি। এক, দুর্গা। দুই, কালী। তাঁদের কে কীসের প্রতীক, সে সব পণ্ডিতদের বিচার্য। কিন্তু তাঁরা আমাদের আড়ম্বর করতে শেখান, দারুণ সাজসজ্জা করে সর্বজনকে মুগ্ধ করতে শেখান, রক্তস্নাত এবং নিনাদকম্পিত ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের সাধনা করতেও শেখান। কলকাতা এই দুই দেবীর আরাধনাতেই খুব নাম কিনেছে। কিন্তু এই দুই মায়ের মাঝামাঝি আর এক মা-ও আসেন। জাঁকজমক নেই, শব্দের তাণ্ডব নেই, চুপচাপ, ছিমছাম, পরিপাটি। আসেন, বড় মণ্ডপের মাঝখানে একলাটি বসে থাকেন, আবার মৃদু রবে চলে যান। আড়ম্বর ছাড়া আমাদের মন ওঠে না, তাই আমরা তাঁর দিকে ফিরেও তাকাই না। কলকাতা নিয়ে অনেক আড়ম্বরের কথা শোনা যাচ্ছে। ওগুলো কিঞ্চিৎ কম হলে ক্ষতি নেই। তার চেয়ে চুপচাপ, ছিমছাম, পরিপাটি করে শহরটাকে একটু লক্ষ্মী করে তুললে বেশ হয়। |
|
|
|
|
|